ব্যাগ গুছিয়ে...
যেন স্বর্গকে ছোঁয়া
প্রাতরাশ সেরে যখন বেরনো হল, পারি তখনও গভীর ঘুমে। নতুন সেই দেশে যাওয়ার পথটা বেশ মনোহারি। মাঝেমধ্যেই রুক্ষ পাথুরে জমি। সেটা ছাড়ালে কখনও সবুজ, কখনও হলুদ, কখনও আবার এই দুই রঙের কোলাজ। দিগন্তবিস্তৃত এলাকা জুড়ে একটা কার্পেট বিছানো যেন! মোট আট ঘণ্টার যাত্রাপথে প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর মিনিট পনেরো-কুড়ির বিশ্রাম। যেখানে বাস দাঁড়াচ্ছে, সেটা একটা ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। পাওয়া যায় না হেন জিনিস নেই। আয়েস করে সারা যেতে পারে লাঞ্চ। অবশেষে সেই পাহাড়ে, সবুজে ঘেরা ছিমছাম দেশ সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন শহরে যখন পৌঁছলাম, তখন মাঝ বিকেল। আমাদের গন্তব্য অবশ্য লুসার্ন নয়, আর একটু দূরের শহর এঙ্গেলবার্গ। তার আগে এক ঘণ্টার ঝটিকা সফরে লুসার্ন শহরটাকে একটু পরখ করে নেওয়া।
প্রথমে যাওয়া ‘লায়ন মনুমেন্ট’ দেখতে। নামে মনুমেন্ট হলেও এটি আদতে একটি ভাস্কর্য। তাতে ফুটে উঠেছে একটি সিংহের অভিব্যক্তি। তীরবিদ্ধ অবস্থায় তার চোখ দিয়ে নেমেছে জলের ধারা। পাথর কেটে তৈরি করা এই অপূর্ব কীর্তি দেখে সাধারণের চোখেও হয়তো অজান্তে জল আসবে। লায়ন মনুমেন্টের সামনে ছোট্ট একটি ফোয়ারা। এর পরে বেশ কিছুক্ষণ ফ্রি টাইম। সেই ফাঁকে একটু দোকানপাট দেখে নেওয়া। ইচ্ছে হলে লুসার্ন লেকের পাশ দিয়ে করা যেতে পারে ইভনিং ওয়াক-ও। কাচের মতো স্বচ্ছ লেকের জলে তখন সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ডিনার সেরে সোজা হোটেল।
যার টানে সুইৎজারল্যান্ড ছুটে আসা, সেই পাহাড় মাউন্ট টিটলিস দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য। এঙ্গেলবার্গ থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশের পথ। বাস দাঁড়াল প্রবেশপথ থেকে সামান্য দূরে। চার দিকে মন-ভাল-করে-দেওয়া মিঠে রোদ। দোসর হাল্কা ঠান্ডা হাওয়া। শোনা গেল, মাউন্ট টিটলিসের মাথায় উঠতে হবে তিন ধাপে। প্রথম দু’টি ধাপ কেব্ল কারে এবং সব শেষে লিফ্টে। মনে মনে উত্তেজনাকে সঙ্গী করে কাচ দিয়ে ঘেরা কেব্ল কারে করে যত উঠতে লাগলাম, নীচের উপত্যকা ততই যেন আরও বেশি সবুজ হতে লাগল। কানে আসছিল ঠুংঠাং ঘণ্টার আওয়াজও। বিস্ময়ে নীচে তাকিয়ে দেখি, সবুজ ঘাসে চরে বেড়াচ্ছে একপাল গরু! তাদের গলায় ঘণ্টা বাঁধা।
সত্যিই যখন সেই পাহাড়চূড়ায় পৌঁছলাম, মনে হচ্ছিল স্বর্গকে ছোঁয়া যাবে। যে পাশেই তাকানো যাক না কেন, পুরু বরফের চাদরে ঢাকা। সেখানে তৈরি রয়েছে ‘আইস কেভ’ও। কাঠের দরজা ঠেলে সেই গুহায় ঢুকলে সমস্বরে কানে আসবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীত। এমন পরিবেশে ঘর বাঁধার ইচ্ছেও কিন্তু হতে পারে! কোথা দিয়ে যে দেড় ঘণ্টা কেটে গেল, টেরই পেলাম না।
সত্যি বলতে কী, পাহাড়চূড়া থেকে নামতেই চাইছিল না অবাধ্য মনটা। আবার এঙ্গেলবার্গ শহরটা চেখে দেখার রোমাঞ্চও যাচ্ছিল না এড়ানো। তাই পাহাড় থেকে নেমে বাসে করেই দেখে নেওয়া এঙ্গেলবার্গ শহরটাকে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শহরটা চলেছে নিজস্ব ছন্দে, ধীর লয়ে। সুন্দর এমন এক শহরে ইচ্ছে থাকলেও দু’দিনের বেশি থাকার উপায় নেই। কারণ পুরো সফরটাই আষ্ঠেপৃষ্ঠে সময়ের কঠিন নিগড়ে বাঁধা। অগত্যা হেটেলে ফিরে খাওয়া সেরে আবার স্যুটকেস গোছানোর তাড়া। কারণ পরের দিনই নতুন দেশে যাওয়া যে!
ঘড়ির অ্যালার্ম যখন ঘুম ভাঙাল, দিনের আলো তখনও ভাল করে ফোটেনি। হোটেলের বারান্দার পাশেই টলটলে নীল জলের লেক। দূরে উঁচু-নীচু পাহাড়চূড়ার হাল্কা আভা। ভোরের সেই সৌন্দর্যটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যেতে পারে বারান্দায় বসেই। কিন্তু আমাদের তো সে উপায় নেই। ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি’। গন্তব্য ইতিহাসের আর এক শহর ইতালি। প্রথম ঠিকানা ফ্লোরেন্স। পথে পড়ল মাত্র ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সেন্ট গথার টানেল। আমাদের যিনি গাইড, তিনি জন্মসূত্রে ইতালীয়। তাঁর মুখে ফ্লোরেন্সের গল্প শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম পিসায়। সেই স্কুলবেলায় ইতিহাসে পড়া যেটা নিয়ে ছিল অপার কৌতূহল, এ বার চাক্ষুষ করলাম পিসার সেই হেলানো টাওয়ার। টাওয়ারের মাথায় উঠতে গেলে ভাঙতে হবে ৫২৯টি সিঁড়ি। লোকমুখে জানা গেল, প্রতি বছর এই বস্তুটি নাকি ২-৩ মিলিমিটার করে হেলছে। ওই চত্বরেই ছাতা, ব্যাগ, ছোট ছোট স্মারক মায় জুতোর পসরা সাজিয়ে বসে গিয়েছে দোকান। চোখে পড়ল বেশ কিছু বাংলাদেশি দোকানও। টাওয়ারের সামনে যে সবুজ চত্বর, তার নাম ‘স্কোয়ার অফ মিরাক্ল’। আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য সেখানে ‘মিরাকিউলাস’ কিছু ঘটেনি।
পিসা ঘুরে যাওয়া ভ্যাটিকান সিটি। একটা শহরের মধ্যে যে লুকিয়ে থাকতে পারে গোটা একটা দেশ, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। স্থানীয় গাইড রবার্তো তাঁর ভাঙা ইংরেজিতে ভ্যাটিকানের ইতিহাস বলতে বলতে নিয়ে চললেন পথ দেখিয়ে। অজান্তেই কখন যে ঢুকে পড়বেন বিশ্বের ক্ষুদ্রতম এই দেশে, বুঝতেই পারবেন না। একে একে ঘুরে দেখা মহামান্য পোপের প্রাসাদ, গির্জা-সহ নানা নিদর্শন। বিশাল গির্জার ভিতরে দুই দেওয়াল জুড়ে বিবিধ পেন্টিং এবং কারুকাজ। গাইডের কাছ থেকে জানা গেল, এই দেশের রয়েছে নিজস্ব খবরের কাগজ, জাতীয় পতাকা এমনকী নিজস্ব মুদ্রাও। ভ্যাটিকান সিটি ঘুরে ঢুকেছি একটা কিউরিও শপে। ছোট্ট একটা জিনিস কেনার পরে দোকান-মালকিন বললেন ‘গ্রাৎসিয়ে’। প্রত্যুত্তরে মুখ দিয়ে কিছু বেরোল না। পরে শুনলাম, ওই শব্দটা বাংলা ‘ধন্যবাদ’-এর ইতালীয় অনুবাদ। সেটা জেনে ফের সেই দোকানে ঢুকে মালকিনকে ‘গ্রাৎসিয়ে’ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। ফ্লোরেন্সে এক রাত কাটিয়ে পরদিন যাত্রা রোমের উদ্দেশে। পথে পড়ল ছবির মতো টাসক্যানি শহর। মধ্যযুগে যে রেনেসাঁ ছড়িয়ে পড়েছিল ছোট্ট, প্রায় অখ্যাত এই রোম থেকে সারা বিশ্বে, তার সাক্ষী বিখ্যাত কলোসিয়াম, রোমান ফোরাম, ভিত্তোরিয়া ইমান্যুয়েল মনুমেন্ট। হেঁটেই ঘুরে দেখা ‘পিয়াৎজা ডেলা সিগনোরিয়া’, রং-বেরঙের ঘষা কাচে ঘেরা ব্যাপটিস্ট্রি এবং ‘ডোর অফ প্যারাডাইস’। ইতালিতে আমাদের শেষ ঠিকানা ভেনিস। চারপাশে জলের মধ্যে গড়ে উঠেছে এই শহর। নেপোলিয়ন এই শহরকে বলেছিলেন ‘বিশ্বের বৃহত্তম ড্রয়িং রুম’। ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ করে সমুদ্র পার হয়ে প্রথমে আসা সেন্ট মার্কাস স্কোয়্যারে। পড়ন্ত বিকেলে, বিশাল সেই স্কোয়ারে তখন কয়েকশো পায়রার কিচিরমিচির। পুরো শহরটাকে ঘিয়ে রেখেছে যে অসংখ্য ছোট ছোট খাঁড়ি, সেগুলিই তার রাস্তা। গন্ডোলায় চেপে ঘোরার ফাঁকে দু’পাশে দেখা যাবে ভেনিসের সুবিখ্যাত ম্যুরানো গ্লাস সামগ্রীর নানা দোকান। সব দেখেও যেন আশ মেটে না। ভেনিসের টুকরো টুকরো ছবি মনে এঁকে ফিরে আসা হোটেলে। আরও একটা দেশ দেখার অপেক্ষায় প্রহর গোনা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.