|
|
|
|
প্রজাতন্ত্রের আশীর্বাদ থেকে যাঁরা অনেক দূরেই রয়ে গেলেন |
যাঁরা আশিসধন্য, তাঁদের আলোকিত জীবনের বৃত্তে কোনও অনিশ্চয়তা নেই, অনাহার
বা অপুষ্টি নেই, বেরোজগারির যন্ত্রণা নেই। এই আলোকবৃত্তের বাইরে পড়ে রইলেন যাঁরা,
প্রজাতন্ত্রের মহিমা কি তাঁদের সত্যিই কোনও কাজে লাগতে পারে? লিখছেন
গৌতম রায় |
ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কাদের কাছে উদ্যাপনযোগ্য, তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। যারা এই প্রজাতন্ত্রে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছে, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, কর্মসংস্থানে ভরপুর ও উজ্জ্বল জীবনে সাফল্য, প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা লাভ করেছে, প্রজাতন্ত্রের বার্ষিক উদ্যাপন তাদের অনেকের কাছেই তামাশা বা নৌটংকির বিরক্তি নিয়ে হাজির হলেও মনে-মনে তারা এই প্রজাতন্ত্রকে আশীর্বাদই করেছে। তাদের আলোকিত জীবনের বৃত্তে কোনও অনিশ্চয়তা নেই, অনাহার বা অপুষ্টি নেই, বেরোজগারির যন্ত্রণা নেই। কেবল আছে শপিং মলের পছন্দের স্বাধীনতা, উৎকর্ষের সাধনায় মগ্ন হওয়ার নিরুপদ্রব পরিপার্শ্ব। এই আলোকবৃত্তের বাইরে পড়ে রইল যারা, প্রজাতন্ত্রের মহিমা কি তাদের সত্যিই কোনও কাজে লাগতে পারে?
প্রতি বছর যে ৫৫ হাজার অপুষ্ট প্রসূতি সন্তানের জন্ম দিতে গেয়ে মারা যাচ্ছে, প্রজাতন্ত্র কখনও তাদের কথা ভাবেনি। প্রথম জন্মদিন পালনের আগে, প্রায়শ জন্মের দু-এক মাসের মধ্যে যে ১৩ লক্ষ শিশু প্রতি বছর মরে যায়, প্রজাতন্ত্রের কাছে তাদের তো কোনও প্রত্যাশা তৈরি হওয়ারই সুযোগ পেল না। পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের মধ্যে যে ৫৯ শতাংশ অপুষ্টির কারণে শরীরে-মনে খর্ব হয়ে থাকে, তাদেরও ক’জনই বা নিজেদের ষষ্ঠ জন্মদিন অবধি বেঁচে থাকে? পাঁচ বছর না পেরোলে এখনও যে এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের জন্মদিন পালন করার রীতি নেই, বহুপ্রসবা মায়েদের শিশুরা যাতে আঁতুড়েই যমরাজের কৃপাধন্য না হয়, সে জন্য যে তাদের গু-গোবর দিয়ে ডাক-নাম রাখা হয়, এই রেওয়াজও তো ৬৩ বছরের তরুণ প্রজাতন্ত্রের স্বোপার্জিত অন্ধকার? যে ৪০ কোটি ভারতীয় প্রতি রাতে পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যায়, তারা এটা জেনে কী করবে যে, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিগত ছয় দশকে মোট জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে ৫০০ গুণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ১২৮ গুণ, সিমেন্ট উৎপাদন ৭০ গুণ এবং ইস্পাত উৎপাদন ৫০ গুণ? |
|
যে সাড়ে আট কোটি আদিবাসী, দলিত ও অনগ্রসর কেবল ২০০৬ সাল পর্যন্ত নদী-বাঁধ, খনি-খাদান, বৃহৎ শিল্পপ্রকল্প ও কলকারখানার জন্য তাদের জমি-জল-আকাশ থেকে উৎখাত হয়ে কার্যত ভিখারি, ভবঘুরে, যাযাবরের জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে, এই প্রজাতন্ত্র নিশ্চয় তাদের জন্য নয়। ১৯৪৮ সালে ওড়িশার সম্বলপুরে মহানদীর উপর হীরাকুদ বাঁধ উদ্বোধন করার সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ওই বাঁধের জন্য উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের বলেছিলেন ‘তোমাদের যদি এ জন্য দুঃখকষ্ট সইতেই হয়, তবে দেশের জন্য তা সহ্য করা উচিত’। দেশের জন্য, প্রজাতন্ত্রের জন্য ভিটেমাটি, জলজঙ্গল ছেড়ে যাওয়া ওই লক্ষ্মণ দুসাদ, অর্জুন কাহার আর সোম্রা লোহারদের কিন্তু এই প্রজাতন্ত্র আজও সম্মানযোগ্য পুনর্বাসন দেয়নি। এমনকী প্রজাতন্ত্রের দুধ-ক্ষীর-ননী-ছানা খেয়ে যারা পুষ্ট হচ্ছে, তাদের কাছে নিজেদের সর্বস্বত্যাগের বিনিময়ে কোনও মৌখিক কৃতজ্ঞতাও জোটেনি। যে এক-চতুর্থাংশ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন পেয়েছে, তারাও কোনও অর্থকরী বা সম্মানজনক বৃত্তিতে যুক্ত হতে পারেনি, ইঁট-ভাটি, পাথর-খাদান কিংবা চা-বাগানে হাস্যকর রকমের কম মজুরিতে শ্রমদাসের জীবন কাটাচ্ছে।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের আকাশ নারীর জন্য তার অর্ধেক কখনওই বরাদ্দ রাখেনি। বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, আফগানিস্তান, কঙ্গো ও পাকিস্তানের পর মহিলাদের নিরাপত্তা ও স্ফূর্তির পক্ষে চতুর্থ নিকৃষ্টতম দেশ হল ভারত। সারা বিশ্বে যত বাল্যবিবাহ হয়, তার চল্লিশ শতাংশই ঘটে ভারতে। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের বিয়ে হয়ে গেছে আঠেরো বছরে পা দেওয়ার আগেই। ত্রিশ লক্ষ নথিভুক্ত যৌনকর্মী (যাদের ৪০ শতাংশই আবার শৈশব-অনুত্তীর্ণ কন্যা), বছরে পাঁচ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যার ফলে জনসংখ্যা থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া অগণিত সম্ভাবনাময় নারী, রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে লক্ষ-লক্ষ নারী পাচার, বে-জাতে বা স্ব-গোত্রে বিয়ে করার অপরাধে ‘পরিবারের সম্মানরক্ষা’র স্বার্থে মেরে ফেলা, পণ-প্রথা ও অন্যান্য কারণজনিত বধূ-নিগ্রহ, বধূ-হত্যা, বর্ধমান ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ও বলাৎকার সহ রকমারি যৌননিগ্রহঅর্ধেক আকাশকে মেঘমুক্ত করার উপযুক্ত আবহই বটে। এর চেয়ে সোমালিয়া-ইথিওপিয়াও ভাল, হয়তো সৌদি আরবও!
১৯৫১ সালে অসমের মাচাঙ লালুংকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬ অনুচ্ছেদে গ্রেফতার করা হয়েছিল ‘গুরুতর ক্ষতি করা’র অভিযোগে। বলা বাহুল্য, ভুয়া অভিযোগ। অভিযোগ সত্যি হলেও বড় জোর দশ বছরের কারাবাস ধার্য হতো। কিন্তু প্রজাতন্ত্র লালুংয়ের কথা বেমালুম ভুলে গেল। যখন মনে পড়ল, তত দিনে ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে। মানবাধিকার কর্মীদের তৎপরতায় ২০০৫ সালে লালুং যখন ছাড়া পেলেন, তাঁর নিজেরও মনে নেই যে, তিনি একজন মানুষ। অসমেরই জেলে বিনা বিচারে ৩৫ বা ৩২ বছর ধরে পচছেন খলিলুর রহমান, অনিল বর্মণ, সোনামণি দেব ও পার্বতী মল্লিক। প্রজাতন্ত্রের নিশ্চয় এঁদের কথাও মনে নেই। ২০০২ সাল পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন জেলে যে ৩ লক্ষ ২২ হাজার বন্দি আটক রয়েছে, তাদের তিন-চতুর্থাংশই বিনা বিচারে আটক এবং অধিকাংশই জামিনের সামান্য অর্থ জোগাড় করতে না-পারার জন্য নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা বন্দিত্বের অসম্মান ও অবক্ষয়ে কাটাচ্ছে। এরা কি সকলে প্রজাতন্ত্র দিবসের উদ্যাপনে উদ্বাহু হবে?
ওই আলোকিত উদ্যাপনের বৃত্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন মণিপুরের সেই মায়েরাও, প্রজাতন্ত্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত অসম রাইফেল্সের জওয়ানদের হাতে নিজেদের কন্যাদের ধর্ষিত হতে দেখে যাঁরা সেনা-দফতরের সামনে গিয়ে অনুপম প্রতিবাদে বিবস্ত্র হয়ে প্রজাতন্ত্রকে ধিক্কার জানিয়ে চিৎকার করেছিলেন‘এসো, এ বার তবে আমাদেরও ধর্ষণ করো!’
বৃত্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকার গরিব বেকার তরুণরাও, যারা অত্যাচারী পুলিশকে লক্ষ করে ঢিল ছুঁড়লে জবাবে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে, বেঁচে থাকলে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হয়ে থানা লক-আপে নির্যাতিত হয় এবং পরে স্রেফ ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায় কিংবা গণ-গোরস্তানে হারানো কঙ্কাল হয়ে শুয়ে থাকে। প্রজাতন্ত্র তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত স্বদেশ হবে, নাকি জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ? উপত্যকার যে ৯ বছরের শিশুকে গত ষোলো বছর ধরে ‘অপরাধপ্রবণতা’র জন্য জুভেনাইল হোমে আটকে রাখা হয়েছে, আজ পঁচিশ বছরের সেই যুবক ইতিমধ্যেই উন্মাদ হয়ে না গেলে অবশ্যই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ই হবে, এই প্রজাতন্ত্র থেকে বরাবরের মতো বিচ্ছিন্ন হয়েই তার সুখ। মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের যে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা মাওবাদী সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্নে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, প্রজাতন্ত্র তো তাদের কাছেও ‘এনকাউন্টার কিলিং’-এর বধ্যভূমি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
যারা তত উগ্র বা দৃঢ়চেতা নয় কিংবা আরও বেশি অসহায় ও নিরুপায়, তাদের কি প্রজাতন্ত্র নিয়ে কোনও বিকল্প ভাবনা থাকতে পারে? অনাহারে যে আদিবাসীরা মারা যায়, এই প্রজাতন্ত্র বলে, অনাহারে নয়, তারা অপুষ্টিজনিত অসুখে মারা গেছে কিংবা তাদের মৃতদেহের ময়না তদন্তে পাকস্থলীতে যে আমের আঁটি-সেদ্ধ পাওয়া গেছে, তার বিষক্রিয়ায় মরেছে। যেন ভুখা প্রজাকে অপুষ্টি বা আমের আঁটি সরবরাহ করাই এই তন্ত্রের দায়। ভূমিষ্ঠ হতে-না-হতে যে-শিশুরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, প্রজাতন্ত্রের সাফাইতারা অপুষ্ট মায়েদের কারণে অ-জাত, যেন তারা ইচ্ছে করেই কম ওজন নিয়ে জন্মায় কিংবা তাদের মেয়েরা যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার পেয়েও পেটের সন্তানকে অপুষ্ট রাখতে কম খেয়ে থাকে। ঠিক একই ভাবে প্রতি বছর স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে যে সোয়া কোটি পড়তে যাওয়া শিশুর মধ্যে ৬০ লক্ষই চতুর্থ শ্রেণির পর পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, তারাও কি তীব্র দারিদ্র, বাড়ি থেকে স্কুলের যোজন-যোজন দূরত্ব কিংবা শিক্ষকদের ঔদাসীন্যের জন্যই প্রজাতন্ত্র থেকে ছিটকে, ঠিকরে যাচ্ছে না?
ইউএনডিপি-র মানদণ্ড প্রয়োগ করলে ভারতীয় জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ দারিদ্র ও দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। এই কষ্ট-যন্ত্রণা থেকেই ২০১০ সালে প্রজাতন্ত্রের ১৫,৯৫৪ জন কৃষক এবং ২৮,১৫২ জন স্বনিযুক্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। যে গরিব চাষিরা দেনার দায়ে আত্মঘাতী, প্রজাতন্ত্র অবশ্য তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্যে পারিবারিক বিবাদের কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিণাম খুঁজে পায়। যারা মরতে পারে না, কিংবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো বড় শহরে ভাগ্যান্বেষণে পৌঁছয়, তাদের জন্যও এই শীতের রাতে ফুটপাথের বিছানা এবং খওলা আকাশের চাঁদোয়া ছাড়া কিছু জোটে না। কারণ সুপ্রিম কোর্ট বার বার বললেও এই নিরাশ্রয় পথ-মানবদের নৈশ-আশ্রয় গড়ে দেওয়ার মতো দায়বোধ বা বদান্যতা প্রজাতন্ত্রের রাজনীতিকদের নেই। এদের সকলের সম্মিলিত অভিশাপ শিরোধার্য করেই তবে পালিত হোক এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবস! |
|
|
|
|
|