সাজেদ, মাজিদ, ইরশাদ, মুদাসির, মৈজুর... সব মিলিয়ে এগারো জন টগবগে যুবক তখন বিরাট মাপের নেট-এর ভিতর ক্রিকেট নিয়ে মশগুল। ফার্স্ট বোলার মৈজুর আলির দুরন্ত বল বার কয়েক সপাটে মারতে গিয়ে নাগালই পেলেন না আসিফ জিলানি। অনূর্দ্ধ উনিশ মুদাসির ভাট্-ও পেটাতে গিয়ে স্লিপে ধরা পড়ে গেলেন আসিফ খানের হাতে। উবায়েদ আহমেদ তো আবার এমনই ড্রাইভ করলেন যে বল বেরিয়ে গেল নেট ফুঁড়ে। হিমাঙ্কের নীচে থাকা বরফজমাট কাশ্মীর যেন টগবগ করেই ফুটছে। হলেও ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ, কাশ্মীরের এই ক্রিকেট দলটির তুর্কিনাচন দেখতে দেখতে উঁকি দিতে শুরু করল কয়েকটি প্রশ্ন, জিজ্ঞাসাও কিছুটা।
কাশ্মীরের বুকে যাদের আত্মরক্ষার্থে এ কে ফর্টি সেভেন নিয়ে গুলি খেলার কথা, তাঁরা এমন ক্রিকেট খেলতে শিখলেন কবে থেকে? তবে কি ক্রিকেট চর্চার নিজস্ব ইতিহাস আছে ওই ভূখণ্ডের? যদি থেকেই থাকে, তা হলে পঁয়ষট্টি বছরের ভারতে আজও কেন এক জন বোলার অথবা মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান, এক জন উইকেটরক্ষক জুটলেন না ভারতীয় দলে? সুনীল গাওস্কর তো তা হলে ঠিক সমালোচনাই জুড়েছেন। ‘নির্বাচকমণ্ডলী’র বোধ-বুদ্ধি নিয়ে তাঁর যে সংশয়, তা তো মিথ্যে নয়! |
‘শ্রীনগর শের দিল’ ক্লাবের কোচ সাব্বির আহমেদকে এ সব প্রশ্নের মুখেই ছেড়ে দেওয়া গেল। সাব্বির বললেন, ‘কাশ্মীরে ক্রিকেট চর্চা খুব পুরনো নয়। অমর সিংহ ক্রিকেট ক্লাব, শ্রীনগর জিমখানা, বারামূলা ক্রিকেট ক্লাব, অনন্তনাগ ক্রিকেট ক্লাব... সব মিলিয়ে বারো-তেরোটি ক্রিকেট চর্চা কেন্দ্রর কোনওটিই বিশ-বাইশ বছরের পুরনো নয়। তবে ইতিমধ্যেই ভাল ভাল ক্রিকেটার তৈরি হয়েছে। অনেকেই রঞ্জি-তে জায়গা পেয়েছে, আই পি এল-এও জায়গা পেতে চলেছে কয়েক জন। কিন্তু মুশকিল হল, ক্রিকেট চর্চা করে চাকরি জুটছে না কারওর ভাগ্যে। ফলে মাঝপথেই গ্লাভস-প্যাড খুলে আমাদের ক্রিকেটারদের নেমে পড়তে হচ্ছে পারিবারিক ব্যবসায়। ব্যবসা মানে হোটেল ব্যবসা অথবা পর্যটন ব্যবসা।’
টিম ম্যানজার মনজুর অবশ্য বিষয়টির উল্টো পিঠটি দেখালেন: ‘দেখুন, কাশ্মীর রাজ্যটি তো এখনও সন্ত্রাস কবলিত। তার উপর রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শান্তিপূর্ণ নয়। ফলে জামশেদপুরে, কলকাতায় বা পটনায় যে ভাবে ক্রিকেটচর্চা চলতে পারে, কাশ্মীর-শ্রীনগরে সে ভাবে চলেনি। তাই আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সরকারও আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। সে দিনের সেই ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি বাদ দিলে আমার তো মনেই পড়ে না কোনও আন্তর্জাতিক ওয়ান-ডে বা টেস্ট ম্যাচের আয়োজন হয়েছে কাশ্মীরে। সরকারি নজরে কাশ্মীর এখনও বম্ব ধামাকা আর হাজার লোগ মারে গ্যয়ে-র রাজ্য। তাই ক্রিকেটাররাও সাহস পান না কাশ্মীরে আসতে। ফলে আমরা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছি।’
যে কাশ্মীরের শক্তিপুরা থেকে অবন্তীপুরা, রাস্তার দু’ধারে ঘরে ঘরে ব্যাট তৈরির কারখানা, ছেলে বুড়ো মজে রয়েছে ব্যাকরণ মেনে ব্যাট বানাতে, সেই উপত্যকা থেকে আজও কেন এক জন ব্যাটসম্যান তৈরি করা গেল না? ভারতীয় একাদশ নামে যে দুধুভাতু দলটি গড়ে তোলা হয়, যারা শান্তির জন্য ক্রিকেট খেলে বেড়ায়, সে দলেও তো ট্রায়ালে থাকতে পারেন এক জন-দু’জন কাশ্মীরি ক্রিকেটার। সাব্বির আহমেদ আক্ষেপ করছিলেন: ‘কাশ্মীরী শালওয়ালাদের মতো তাই ক্রিকেটাররাও নেমে আসছেন সমতলে। কেউ দিল্লিতে, কেউ চেন্নাইতে, কেউ বা আবার যোগ দিচ্ছেন জামশেদপুরের ক্রিকেট ক্লাবগুলিতে। যদি চান্স পাওয়া যায়!’
এ ব্যাপারে কাশ্মীরকে পথ দেখিয়েছেন দুই ফুটবলার, ইসফাক হোসেন এবং মেহরাজুদ্দিন। দুই কৃতী খেলোয়াড়ই সটান কলকাতায় এসে মোহনবাগানে খেলে কাশ্মীরের নাম রৌশন করেছেন। সাব্বিরের ভরসা, ক্রিকেটাররাও সেই পথ ধরে অনতিবিলম্বেই জায়গা করে নেবেন ভারতীয় দলে। ‘আমরা যারা কাশ্মীরে এত দিন ধরে ক্রিকেট নিয়ে পড়ে আছি, আমাদের কাছেও তো এটা একটা আবেগ কেন ভাল ক্রিকেটার তৈরি করতে পারছি না আমরা? কেন আমাদের দিকে বার বার সরকারি সন্দেহের আঙুল তোলা হয় আমরা নাকি ভারতের খেয়ে পাকিস্তানের মোষ চরাই...?’
এ বার তবে সেই অপ্রিয় জিজ্ঞাসাটি না করলেই নয়: ভারত-পাকিস্তান ওয়ান-ডে বা অন্য কোনও সমরে কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া কী? আমাদের এ শহরে পার্কসার্কাসে, রাজাবাজারে, কলাবাগানে বা মেটিয়াবুরুজে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলে যেমন পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা যায়, কাশ্মীর...।
সাব্বির আহমেদ কথা শেষ করতে দিলেন না: ‘হ্যাঁ, ক্রিকেট যারা খেলে না, যারা ক্রিকেট দেখে, তাদের মধ্যে ওই জিনিসটা আছে। পাকিস্তানের পতাকা ওড়াবে, হজরতবাল মসজিদে গিয়ে পাকিস্তানের জন্য প্রার্থনা করবে, ক্রিকেট খেলা চলার সময় ব্যান্ড বাজাবে। কিন্তু আমরা যাঁরা ক্রিকেট খেলি, তাঁদের কাছে ইন্ডিয়া হোক আর পাকিস্তান, পারফরমেন্সটাই আসল। যে দিকের পারফরমেন্স ভাল, আমরা সেই দিকটাকেই সমর্থন করি। কেন, বিশ্বকাপ ফুটবলের মরশুমে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা যখন উঠে আসে, গোটা ভারতই তো দু’দেশের জার্সি আর পতাকা ছেয়ে যায়। তখন কি ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান স্পোর্টিং বা সালগাওকর গেল-গেল রব তোলে?’
কাশ্মীরের ছেলেরা যদি ক্রমাগত চেষ্টা করেও ভারতীয় জুনিয়র বা সিনিয়র দলে জায়গা না পায়, এবং সেই মুহূর্তে যদি পাকিস্তান থেকে দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান আসে, কী করবেন কাশ্মীরের ক্রিকেটাররা? ‘শুধু পাকিস্তান কেন, বাংলাদেশ, জিম্বাবোয়ে ডাকলেও ওরা বেরিয়ে যাবে।’ বললেন টিম ম্যানেজার মনজুর। |