প্রজাতন্ত্রের নানা মানে, নানা সংজ্ঞা হতেই পারে। তবে প্রজাতন্ত্রের একটা অর্থ বোধ হয় অংশগ্রহণ। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিকতায় প্রজাদের অংশগ্রহণ না ঘটলে তো আর প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ ও শর্ত রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রজাদের এই যোগদানের বিষয়টি রাষ্ট্রশক্তি মাঝে মাঝে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। হয়তো কোনও স্বৈরাচারী দল ক্ষমতা দখল করেছে, তারা চায় না প্রজারা, অর্থাৎ স্বাধীন নাগরিকেরা তাঁদের কাজে-কর্মে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজনীতিতে আসুন। আরেকটা কাণ্ড হতে পারে। নাগরিকদের দিক থেকে এক রকম উদাসীনতা চোখে পড়ে এই সব রাজ্য-রাজনীতি চুলোয় যাক, এ সব করে কিছু লাভ নেই। ইদানীং কয়েকটি ঘটনায় মনে হল, এই অংশগ্রহণের বা যোগদানের রাজনীতি ব্যাপারটা কেমন যেন গুলিয়ে গেছে , বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে। পর পর খবরে প্রকাশ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের হাতে শিক্ষকেরা নিগৃহীত হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন পালাবদল পরবর্তী দশা। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার পর একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সরে গেছে, তার বদলে আর একটি দল এসেছে। এ সব ক্ষেত্রে পালাবদলের পর রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়, এখানেও হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এই সংঘর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হচ্ছে, সেহেতু এর অন্য একটি মাত্রা আছে বলে মনে হয়।
এমনিতে ছাত্রদশাতেই তো অংশগ্রহণের রাজনীতি শেখার কথা। আমদের দেশে ছাত্র-রাজনীতির সূত্রপাত, অন্য অনেক কিছুর মতোই, উপনিবেশ পর্বে। শাসক ইংরেজরা এ দেশ শাসন করার জন্য যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তাতে ভারতীয় ছাত্ররা যত বেশি যোগ দেন তত ভাল। দেশের কথা, দেশের মানুষদের কথা তা হলে বলা যাবে। দিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন বন্ধু সুভাষচন্দ্রের কথা। সুভাষ খুব সচেতন ভাবে ছাত্র দশা থেকে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। বন্ধু দিলীপকুমারকে বলেন কলেজের ডিবেট ও অন্যান্য বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। এই সব প্রতিযোগিতার অনেক গুণ। ইংরেজি বলার অভ্যাস ঝালিয়ে নেওয়া যায়। সুভাষ তার ছাত্রদশাতে ঠিক করে নেন, তিনি অবসর সময়ে কী পড়বেন এবং কী পড়বেন না। যা পরাধীন দেশের রাজনীতিতে যোগদানের জন্য কাজে লাগবে, তা ভাল পড়া, আর যা কাজে লাগবে না, তা খারাপ পড়া। কাজেই সুভাষ নাটক নভেল পড়ে সময় নষ্ট করতে নারাজ। বিবেকানন্দের লেখাপত্র পড়া যেতে পারে। |
সুভাষচন্দ্রের মতো সচেতন ছাত্র সবাই নাও হতে পারে। তবে অংশগ্রহণের পদ্ধতিটি যে ছাত্র অবস্থাতে শেখা চাই তা রবীন্দ্রনাথও মনে করতেন। বোলপুরে যে বিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বিদ্যালয়টিকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কবলে তিনি নিয়ে যেতে চাননি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের দায়িত্বসচেতন করে তুলতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখার সাক্ষ্য হাজির করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনেথের পাঠভবন স্কুলের শিক্ষক বিভূতিভূষণ গুপ্ত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পুরনো লিখিত কপি থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমের শিক্ষাদর্শ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি রচনা মুদ্রিত করেন। এই রচনাটিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নিজেদের পরিচালনার জন্য ছাত্ররা বিধিব্যবস্থা নিজেরা প্রণয়ন করিবে ও তাহা পালন করিবার মতো দায়িত্ববোধ তাহাদের মধ্যে জাগরিত করা চাই।’ এ হল ছাত্রজীবনকে গড়ে তোলার আর এক পদ্ধতি। সুভাষচন্দ্রের মতো প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ভাবনা এতে নেই, কিন্তু ছাত্রজীবনের দায়িত্বের কথা আছে। আমাদের ছাত্র রাজনীতির একটা বড় উদ্দেশ্য কিন্তু এই রকমই ছাত্রদের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে ও তার সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে। সুভাষচন্দ্রের মতো যদি প্রত্যক্ষ রাজনীতির স্বপ্ন নাও থাকে, তবু এই দায়িত্ববোধ থেকে পরে প্রজাতন্ত্র যে যোগদানের কথা বলে সেই যোগদান শিক্ষা সম্ভব।
মুশকিল হল, ইদানীং ছাত্র রাজনীতিতে এই দু’রকম দিকই চোখে পড়ে না। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য নিজেকে শিক্ষিত করে তোলার যে চেষ্টা সুভাষচন্দ্রের মতো যুবকেরা করতেন, তা কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও বেশ চোখে পড়ত। আলাদা করে নামোল্লেখের দরকার নেই, তবে বাম ও দক্ষিণপন্থী দলগুলিতে এখনও অবধি এমন অনেক নেতা আছেন যাঁদের গ্রিনরুম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্র রাজনীতি। ইদানীং তাঁরাই বলেন ছাত্র রাজনীতির সেই মহিমা নেই! এমনকী রাজনৈতিক দলগুলি বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে নতুন প্রজন্মে ভালো নেতা পাওয়া যাচ্ছে না। তেমন ভাবে কে আর নিজেকে গড়ে তুলছে! তা হলে এই যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষরত এরা কারা? অস্বীকার করার উপায় নেই, এই সংঘর্ষে হুজুগেপনা আছে, বাইরের থেকে আসা লোকজন আছে, রাজনৈতিক দলের বাহুবল প্রমাণের তাগিদ আছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য নির্মাণের বা দায়িত্বগ্রহণের ইচ্ছা নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা বড় অংশ অরাজনৈতিক হয়ে উঠছে। তাদের কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আর এই কিছুতেই কিছু না যাওয়া আসা প্রজাতন্ত্রের স্বার্থের পক্ষে কিন্তু ভালো নয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’ উপন্যাসে এক বইমুখো ভালো ছেলের কথা ছিল। সে নিজে চাকরি পেতে চায়। কাজেই ছাত্র-রাজনীতির ডামাডোলে মিশতে চায় না। শেষ পর্যন্ত বইমুখো ভালো ছেলেটি উপন্যাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়। রাজনৈতিক হুজ্জুতেপনা ভাল নয়। এই হুজ্জুতেপনার সুযোগে বাইরের মতলববাজদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার দেওয়া অনুচিত, কারণ তার ফলে শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষালয় সংকটে পড়বে। কিন্তু অসচেতনতাও কী কাম্য? পেশায় শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাই নিত্যদিন ওঠা বসা। ওদের কথা শোনার আর বোঝার চেষ্টা করি। কোনও ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর, চাকরি এ সবের বাইরে দেশ ও দশের হাল চাল নিয়ে দুটো কথা বললে ভালো লাগে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তত মতলববাজি ছাত্র-রাজনীতির কুশীলব আর নিজেদের উদাসীনতার কুয়োর মধ্যে আটকে থাকা মুখ ছাড়া খুব বেশি কিছু চোখে পড়ে না। এই যে ছেলেমেয়েদের উদাসীন অ্যাপলিটিক্যাল করে তোলা বা হয়ে ওঠা, এটা প্রজাতন্ত্রের পক্ষে খুব ভালো নয়, যেমন ভালো নয় রাজনৈতিক ডাণ্ডাবাজি। ফলে প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দা হিসেবে মনটা একটু খারাপই হয়ে যায়। |