আচ্ছা, ঠিক ছাব্বিশ দিন আগে যে বছরটা শেষ করে এসেছি, সেটার কথা মনে পড়ে? একেবারে ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এমন কিছুর দিকে ফিরে তাকাতে বললে কোথায় চোখ পড়বে? অণ্ণা হজারের দিকে?
এত লোক থাকতে অণ্ণা হজারের কথাই তুললাম, কারণ ২০১১ সালে ভারতের অবিসংবাদী নায়ক তিনিই। একেবারে ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ...’ স্টাইলে তাঁর অভ্যুদয় হয়েছিল গত বছর। কেউ না থেকে মহানায়ক উত্থানে সময় লেগেছিল দিনকয়েক।
আর, অন্য সব মহানায়কের মতোই, এই দ্বিতীয় মহাত্মার জন্মদাতাও আমরা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আর এক মহানায়ক যাদের বলেছিলেন ‘শালা পাবলিক’।
রিপাবলিকের পাবলিক। |
রিপাবলিক আমাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই গল্পটা থাক। তবে, পুরোপুরি থাকতে দিলে চলবে না। সেখান থেকে একটা কথাকে আলাদা করে তুলে আনা দরকার সংবিধানে লিখে দেওয়া ক্ষমতা আসলে আমাদের নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে বিশ্বাসটাই নষ্ট করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান পদে যে মানুষটি নির্বাচিত হবেন, তাঁকে বেছে নেবেন আমাদের ভোটে জেতা প্রতিনিধিরা অতএব একটু ঘুরিয়ে হলেও নাক ধরার ক্ষমতা আমাদের আছে এই কথাটি এতখানিই বায়বীয় যে সেই ক্ষমতা, বা বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার মতো কোনও ক্ষমতাই যে আমাদের আদৌ থাকতে পারে, এই বিশ্বাসটি আমাদের নেই। ফলে, আমরা আমাদের ক্ষমতা সম্বন্ধে কার্যত অজ্ঞ, উদাসীনও বটে। কী ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সেই ক্ষমতাকে, কী ভাবে সেই ক্ষমতা হয়তো বদলে দিতে পারে ভারতীয় গণতন্ত্রের আদলটাকেই আমরা ভাবি না। ভাবার যে কোনও প্রয়োজন আছে আদৌ, সেটাই বোধে ধরা পড়ে না।
আমরা নিজেদের অজ্ঞাতেই হয়তো মহানায়কের জন্ম দিই।
যেমন, অণ্ণা। মহারাষ্ট্রের রালেগান সিদ্ধির এই প্রবীণ সমাজকর্মী গত এপ্রিলে দিল্লিতে অনশনে বসেছিলেন। জনলোকপাল বিল পাশ করানোর দাবিতে। ব্যবসার দুনিয়া সম্বন্ধে যাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তাঁরাই জানবেন শুধু ভাল পণ্য তৈরি করতে পারলেই হয় না, জোর মার্কেটিং চাই। তার চেয়েও বেশি চাই উপযুক্ত বাজার। মানে, যে বাজার এই পণ্যের জন্য, অথবা পণ্যের বিজ্ঞাপন যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। অণ্ণা হজারে হয় সৌভাগ্যবান, নয় বুদ্ধিমান, অথবা দুটোই তিনি বাজারের সেই মহেন্দ্রক্ষণে নিজের পণ্যটিকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। ফেসবুকের আপডেটে-আপডেটে তার বার্তা রটি গেল ক্রমে ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন এক প্রবীণ। গাঁধীবাদী? মোহনদাস কর্মচন্দ হাসতেন। কিন্তু, সে কথা থাক। ভারতীয় যৌবন তখন একটি নিজস্ব তহরির স্কোয়্যার পাওয়ার জন্য আকূল হয়ে ছিল। জনলোকপাল কী, তার সঙ্গে দুর্নীতির কী সম্পর্ক আর এই দাবির সঙ্গে গণতন্ত্রের কী বিরোধ অতশত ভাবার সময় তাদের ছিল না। সমর্থনের বন্যায় ভেসে রাজনীতির মহামঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হলেন রালেগান সিদ্ধির মহাত্মা।
তার পর কী হল, কী ভাবে জানা গেল তিনি আসলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একান্ত অনুগত, কী ভাবে তাঁর লোকপালের রাজনীতি পর্যবসিত হল নিছক কংগ্রেস-বিরোধিতায় তার কোনওটাই এই লেখায় আসবে না। তা নিয়ে ঢের কথা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আমরা শুধু এক বার জানতে চাইব, অণ্ণা যে সমর্থনের জোয়ারে তাঁর রাজনৈতিক তরী ভাসিয়েছিলেন, সেই জোয়ারের প্রতিটি জলকণা, অর্থাৎ আমি-আপনি-আমরা কি জানতাম, কোন উদ্দেশে বইয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা সেই তরীটিকে?
আমরা জানতাম না। আমরা জানার চেষ্টা করিনি। একক আমি-র ক্ষমতা এতই কম, এতই তুচ্ছ, নগণ্য যে আমরা ভাবতে শিখিনি যে অগণন একক মিলে যখন আমরা সমষ্টি হয়ে উঠি, তখন কী বিপুল শক্তি সঞ্চিত হয় আমাদের মধ্যে। জোয়ারের প্রতিটি জলকণার মতোই। আমরা যখন জোয়ার হয়েছি, তখনও নিজেদের জলকণাই ভেবে গিয়েছি। ফলে, অণ্ণার রাজনীতি কী, সেই রাজনীতির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক কী, সেই রাজনীতির বড় ছকে আমি ঠিক কোথায় থাকব কিচ্ছুটি না জেনে আমরা সমর্থন করে গিয়েছি তাঁকে। অথবা, কিচ্ছুটি না জেনেই আমরা আমাদের জমে থাকা রাগ উগরে দিয়েছি, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বিরুদ্ধে।
ঠিক এখানটাতে দাঁড়িয়েই এক বার ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি “সার্বভৌম, প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ” দেশের ভিত্তি-গ্রন্থের স্বীকৃতির মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পণ্ডিত নেহরু, বাবাসাহেব অম্বেডকর কি ভেবেছিলেন, তাঁরা আসলে জলকণার হাতে জোয়ারের শক্তি তুলে দিচ্ছেন?
তাঁরা কি ভেবেছিলেন, সেই জোয়ার বন্যা হয়ে আছড়ে পড়তে পারে তাঁদের একটু একটু করে গড়ে তোলা গণতন্ত্রের স্বপ্নের ভিতে? এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কিছু না বুঝেই?
প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটিতে এই প্রশ্নগুলো এক বার ভেবে দেখব? |