|
|
|
|
সে দিনের সংবিধান-সভাতেও মতবিরোধের অন্ত ছিল না |
তবু শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধান জ্বলন্ত মশালের মতো তুলে ধরল দুটি আদর্শকে। এক, গণতান্ত্রিক জাতীয়তা।
দুই, সাম্যবাদ। ‘ন্যাশনাল’ ও ‘সোশ্যাল’: এই দুই আদর্শ আমাদের সংবিধানের ‘যুগল-বিপ্লব’।
অথচ পরবর্তী কালে সেই যুগল বিপ্লবের পথেই এল যুগল সংকট।
লিখছেন
সেমন্তী ঘোষ |
সে ছিল এক জাদুর মুহূর্ত। জওহরলাল নেহরুর মনে হয়েছিল, পুরনো যুগ থেকে এ ভাবে নতুন যুগে চলে যাওয়ার মুহূর্তটির মধ্যে-- ‘দেয়ার ইজ সাম ম্যাজিক’। তিন বছরের স্বাধীন দেশের জন্য বিশ্বের দীর্ঘতম সংবিধানটি তৈরি হওয়ার সময়ে শিহরিত হচ্ছিলেন সে দিনের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কয়েক যুগের অবিশ্রাম সংঘর্ষের দিনগুলো রাতগুলো, তীব্র অন্তর্দ্বর্ন্দ্বে দীর্ণ জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার সুকঠিন অভিজ্ঞতার ওঠা-পড়া। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি “সার্বভৌম, প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ” দেশের ভিত্তি-গ্রন্থের স্বীকৃতির শুভক্ষণে তাঁর নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল সেই দিনের কথাও-- ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৭। সে দিন পরাধীন ভারতে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি বা সংবিধান-সভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন জওহরলাল, যে স্বাধীন দেশটি আর কিছু দিন পরই জন্মাতে চলেছে, সেই দেশের ছবিটা কেমন হবে বলে তাঁর মনে হয়। বলেছিলেন “এই সভার প্রথম কাজ, একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ভারতকে মুক্ত করা, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাদ্য জোগাতে পারা, বস্ত্রহীন মানুষের পরনে বস্ত্র জোগাতে পারা, প্রতিটি দেশবাসীকে তার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বিকাশের সব রকম সুযোগ দিতে পারা।” |
|
মাটির কাছাকাছি। স্বাধীন দেশের কাছে মানুষের প্রত্যাশার কথা শুনছেন জওহরলাল নেহরু। |
কত কী-ই যে ছিল যত্নরচিত সংবিধানটির মধ্যে! ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তৈরি হয়েছিল সংবিধান-সভা, ২৩ জানুয়ারি ১৯৫০ পর্যন্ত কাজ করেছিল বিরামহীন। ৩০০-রও বেশি সদস্য ছিল সেখানে। মত-বিরোধ মত-সমন্বয়ের বহু বন্ধুর পথ পেরোতে হয়েছিল তাকে। যে কমিটিতে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, বি আর অম্বেডকর-এর মতো এক এক জন তীব্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা, সেখানে কি সহজে মতৈক্য হওয়া সম্ভব! যেমন, নতুন দেশের সংবিধানে গাঁধীবাদকে ঠিক কতখানি জায়গা দেওয়া হবে, গাঁধীর গ্রাম-ভিত্তিক সমাজ তৈরির আদর্শকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে, এ নিয়ে রীতিমতো অশান্তি দেখা দেয়। এমনিতেই কংগ্রেসি প্রতিনিধিদের মধ্যে গাঁধীর গ্রাম-ভারতের সমর্থন ছিল জোরালো, তার ওপর আবার সদ্য-বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনপ্রণালী থেকে স্বাধীন দেশকে আলাদা করার মহান্ লক্ষ্যে সেই আদর্শের আহ্বান আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অথচ এ বিষয়ে নেহরু তো সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। অম্বেডকরও কিছু কম যান না। গাঁধীর মতের আদলে যাঁরা গ্রাম-সভা ও পঞ্চায়েতি রাজের পক্ষে আবেগ ও যুক্তির ঘনঘটা তৈরি করছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে অম্বেডকরের ভর্ৎসনা তাই বজ্রসম: “These village republics have been the ruination of India!” আহত ভাবে তিনি বলেছিলেন, আশ্চর্য, যাঁরা অন্য সময় সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা কিংবা অন্যায় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে হইচই করেন, এই সভায় তাঁরাই আবার গ্রামের পক্ষে ওকালতি করছেন? গ্রামগুলিতে অশিক্ষা, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আছেটা-ই বা কী? এ সব শুনে যথারীতি রে-রে করে ওঠেন সদস্যরা। ‘এলিটিস্ট’ বলে যৎপরোনাস্তি গালি হজম করেন অম্বেডকর।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, নতুন দেশ যে ‘স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত না থাকলেও অন্যান্য কিছু আদর্শ নিয়ে কিন্তু মতবিরোধ প্রবল। যেমন, সমাজতন্ত্র। নেহরু তো গোড়া থেকেই সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত। কিন্তু প্যাটেল? তিনি ও তাঁর সমর্থক বহু প্রতিনিধিই মনে করেননি যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দিয়ে নতুন দেশের সমস্যার সমাধান সম্ভব।
কিংবা, ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ। মৌখিক ভাবে প্রদেশের বিশিষ্ট সত্তা-র কথা স্বীকার করলেও কাজের বেলায় কিন্তু দেশভাগ ও দাঙ্গার রক্তক্ষরণ, ভ্রাতৃহননের ভয়াবহ পথ পেরিয়ে সবে উঠে আসা দেশের জন্য শক্তপোক্ত কেন্দ্রীয় শাসনই সর্বোত্তম পথ বলে মনে করেছিলেন নেহরু, প্যাটেল কিংবা অম্বেডকর। ভারত নামে সদ্যোজাত দেশটিকে ছবির মতো বাস্তবেও অটুট, একত্র, একীভূত রাখতে চাইছিলেন তাঁরা। কিন্তু সকলেই কি সেই একই ছবিতে বিশ্বাসী ছিলেন? না। আর যাঁরা চাইছিলেন না, সেই অবিশ্বাসীদের কাছে ভারত কেবলই রাজনৈতিক ভূগোল, সত্যিকারের জাতীয়তা প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক সত্তার মধ্যে। কেন তাকে বিসর্জন দিতে হবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কাছে? তামিল নেতা কে সান্তারামের তীক্ষ্ণ মন্তব্য: এর মানে, প্রদেশগুলিকে ভবিষ্যতে সর্বদা দিল্লির কাছে ভিক্ষে চেয়ে বেড়াতে হবে, তারা হবে ‘beggars at the door of the Centre.’ শেষ অবধি অবশ্য নেহরুরাই জিতলেন। অম্বেডকরের ভাষাতে বললে আমরা পেলাম: ‘A strong united centre (hear, hear) much stronger than the centre we had created under the Government of India Act of 1935.’
অনেক তর্কবিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধান দুটি আদর্শকে জ্বলন্ত মশালের মতো সামনে তুলে ধরল। এক, গণতন্ত্রের পথে হেঁটে একটি ‘জাতীয়’ সমাজ তৈরি। দুই, মানুষের অধিকার ও মুক্তির পথে একটি ‘সাম্যবাদী’ সমাজ তৈরি। ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাসকার গ্র্যানভিল অস্টেন বলেন, ‘ন্যাশনাল’ ও ‘সোশ্যাল’, এই সেই দুই আদর্শ। রামচন্দ্র গুহ বললেন, কেবল আদর্শ বলাই যথেষ্ট নয়। এ ছিল আমাদের সংবিধানের ‘যুগল-বিপ্লব’।
অর্থাৎ, সংবিধান তৈরির আগে ঠিক যে আদর্শগুলি নিয়ে সমস্যার অন্ত ছিল না, শেষমেশ সেই দুই ক্ষেত্রেই ভারতীয় সংবিধানের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসল। বিপরীত মতামতকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত দাঁড়াল যে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই, কিন্তু ‘জাতীয়’ অর্থাৎ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রও বটে। আর, সঙ্গে সঙ্গে, এও ঠিক হল যে, ভারত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র। ক্রমে এই সমাজতন্ত্রের পথেই আসবে রাষ্ট্রায়িত পরিকল্পিত অর্থনীতির দিশা। সব নাগরিকের, সব সমাজের সমান উন্নতি সমাজতন্ত্রের কাম্য। তাই শুরু হবে সংরক্ষণ নীতিও। মজার ব্যাপার, ঠিক এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু পরবর্তী কালে তৈরি হল গভীর ও ব্যাপক অশান্তি। অর্থাৎ যে দুটি নীতিকে ‘যুগল বিপ্লব’ বলা হয়ে থাকে, সেই দুটি নীতির পথেই বেরিয়ে এল ভবিষ্যৎ ভারতের ‘যুগল সংকট’। আমরা সিদ্ধান্ত করতেই পারি যে, সংবিধান সভায় সে দিন যে তর্কবিতর্ক দেখা গিয়েছিল, যে মতবৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে নেহরু-পন্থী সিদ্ধান্তগুলি গৃহীত হয়েছিল, সেই সব বিরোধিতাই আবার তড়িঘড়ি উঠে এল ভারতীয় অস্তিত্বের ওপর-তলে। প্রথম সংকটটা এল ‘জাতীয়’ আদর্শের ফাঁকফোকর বেয়ে। যে ভারত কোনও কালে কোনও ইতিহাসে এই একত্রতা দেখেনি, তাকে একটি সুতোয় গাঁথতে গিয়েই হল মুশকিল। উত্তর থেকে পূর্বে ফুঁসে উঠল বিচ্ছিন্নতাবাদ, দক্ষিণে জেগে উঠল প্রাদেশিক সংস্কৃতির বিদ্রোহী ঘোষণা। |
|
সংবিধানের জনক। ডক্টর বি আর অম্বেডকর |
দ্বিতীয় সংকটটা এল সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ ধরে। কোন সমাজ প্রান্তিক আর কোনটি নয়, কে কত সুবিধে নিজের জন্য রাখতে পারবে, সংরক্ষণে কার ক্ষতি হবে কার লাভ, এই নিয়ে কলরোল ক্রমে জাতপাতের সংঘর্ষে পরিণত হল। বোঝা গেল, ন্যায়ের পথ সহজ নয়: সংবিধানকর্তাদের স্বপ্নে লাগল রক্তের দাগ।
আসলে দুটো সংকটের মূলে আছে একটিই সমস্যা। গণতন্ত্র সব মানুষকে সমান রাজনৈতিক অধিকার দেয়। কিন্তু ভারতের অসাম্য-জর্জরিত সমাজে সব মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই বিপুল ফারাক। কী করে মিটবে এই স্ববিরোধিতা? সংবিধান-রচয়িতারা কিন্তু সেই প্রথম দিনই কথাটা বলে যেতে ভোলেননি, সতর্কবাক্য উচ্চারণ করতে পিছ-পা হননি। অম্বেডকর-এর মুখ থেকেই এসেছিল সেই মন্তব্য: “On the 26th of January, we are going to enter a life of contradictions. ... How long shall we continue to live this life of contradictions? ... If we continue to deny it for long, we do so only by putting our political democracy in peril.”
এই স্ববিরোধিতা ভুলে গেলে, তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না করলে প্রজাতন্ত্রের বিপদ, গণতন্ত্রের বিপদ। অম্বেডকররা ভোলেননি এই জরুরি কথাটা। আরও একটা কথা তাঁরা পরোক্ষ ভাবে বলে গিয়েছিলেন, যে কথাটা এই উদ্ধৃতির মধ্যেও প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
আসলে সেই ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তাঁদের নেতৃত্বে তো প্রজাতন্ত্র ‘প্রতিষ্ঠিত’ হয়নি, প্রজাতন্ত্রের দিকে যাত্রাটির সূচনা হয়েছিল মাত্র। ‘Enter a life of contradictions’ বলতে কেবল ‘contradictions’-ই তো নয়, ‘entering’ অর্থাৎ প্রবেশের কথাটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রজাতন্ত্রের পিতৃসম নেতারা।
বোঝাতে চেয়েছিলেন, গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা কিন্তু প্রতি দিনের, প্রত্যেকের। |
|
|
|
|
|