রুগ্ণ সরকারি পরিবহণ থেকে ভর্তুকির খুঁটি পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়ার কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন মঙ্গলবারই। অথচ বুধবার নতুন পরিবহণমন্ত্রী সেই মদন মিত্রই সুর পাল্টে জানান, এক বারে সব ভর্তুকি বন্ধ করার পক্ষপাতী তাঁরা নন।
ফলে প্রশ্ন উঠে গেল, রুগ্ণ পরিবহণ সম্পর্কে রাজ্য সরকারের নীতিটা আসলে কী?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম পরিবহণমন্ত্রী সুব্রত বক্সি পরিবহণ নিগমে ভর্তুকিতে রাশ টানতে বেতন-পেনশন স্থগিত রাখার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রতিটি নিগমের কর্তাকে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজতে। লোকসানের ভারে ন্যূব্জ সংস্থার বোঝা সরকার যে আর বইবে না, ৩ জানুয়ারি মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীও তা স্পষ্ট করে দেন। মঙ্গলবার নয়া পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবুর গলাতেও শোনা গিয়েছিল একই সুর। তাঁর মন্তব্য, ‘‘নিগমগুলোকে ভর্তুকি দেওয়ার জায়গায় সরকার নেই। টাকা কোথা থেকে আসবে?” পরিবহণ-কর্মীদের অনিয়মিত বেতনের সমস্যা যে এখনই মিটছে না, মন্ত্রী তা-ও জানাতে কসুর করেননি।
কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আগের মত থেকে অনেকটা ঘুরে গেলেন পরিবহণমন্ত্রী। এ দিন মদনবাবু বলেন, “এক ধাক্কায় সব বন্ধ করে দেওয়া হবে, এটা ঠিক নয়। আগে পরিবহণে ৮০% ভর্তুকি দেওয়া হত। এখন ৫% কমিয়ে ৭৫% করা হয়েছে। ভর্তুকি মোটেই বন্ধ হয়নি। ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে মাত্র।” মঙ্গলবার কর্মী সংগঠন সম্পর্কে ‘কড়া’ মনোভাব প্রকাশ করলেও এ দিন তাদের প্রতি পরিবহণমন্ত্রীর সুর ছিল যথেষ্ট নরম। মঙ্গলবার তিনি বলেছিলেন, ইউনিয়নের লোকজনের ‘যখন-তখন’ মহাকরণে আসা চলবে না। আর এ দিন তাঁর মন্তব্য, “ইউনিয়নগুলো কাজ করতে চায়। আগের সরকারই ওদের দিয়ে কোনও কাজ করাতে পারেনি।”
চব্বিশ ঘণ্টায় মন্ত্রীর বক্তব্য এ ভাবে পাল্টে গেল কেন? পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর: মঙ্গলবার বিকেলে এক সিটিসি-কর্মীর অপমৃত্যুর ঘটনাটি যাতে পরিবহণ-কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না-করে, সে জন্যই মদনবাবুর এ দিনের সুর ছিল অনেকটা নরম। মৃতের পরিবারের অভিযোগ, তিন মাস বেতন না-পেয়ে অর্থকষ্টে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। এবং এ দিন মন্ত্রীর দাবি, “আমি আমার বক্তব্য থেকে সরিনি। কখনওই বলিনি যে, ভর্তুকি একবারে বন্ধ করে দেব। সরকার মানবিক মুখ নিয়ে ভর্তুকির বিষয়টি দেখছে। প্রতিহিংসাপরায়ণতা নিয়ে নয়। সরকারের ঘাড়ে এখন দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি দেনা। তাই এ বার পরিবহণ সংস্থাগুলোকে আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে।”
এ দিকে পরিবহণে ভর্তুকি প্রত্যাহারের নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “ভর্তুকি সরকারকে দিতেই হবে। পরিবহণ পুরোপুরি বেসরকারি হাতে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে পারে না। কর্মসংস্কৃতি ফেরানো যেতে পারে, সরকার সংস্কারের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু একেবারে হাত গুটিয়ে নেওয়ার নীতি মানা যায় না।”
বাম আমলে পরিবহণে ‘বহু অনিয়মের’ যে অভিযোগ রাজ্য সরকার বার বার তুলছে, সে প্রসঙ্গে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “সে সবের তথ্য দিতে হবে! তা ছাড়া বাম জমানায় পরিবহণে বিরাট সাফল্য ছিল, এমন দাবি আমরা করছি না!” ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্নে সূর্যবাবুর মত, “কী করবে, সেটা সরকারকে ভাবতে হবে। সরকার যদি ঠিক করে থাকে, আয় করব না, শুধু ব্যয় করে যাব, তা হলে কে কী করবে?” সরকারের শরিক কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি’র প্রশ্ন, যারা (তৃণমূল) রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি না-তোলার দাবি জানায়, তারাই কী ভাবে রাজ্যে পরিবহণে ভর্তুকি রদের কথা বলে?
ভর্তুকি বন্ধ করে রুগ্ণ পরিবহণকে জিইয়ে তোলার উপায় খুঁজতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন নিগম ও দফতরের কর্তা এবং ইউনিয়ন নেতাদের বৈঠকে বসার কথা হয়েছে একাধিক বার। বারবার তা পিছিয়ে গিয়েছে। ফলে জানা হয়নি, সরকার নিগমগুলোর কাছে কী চাইছে। বস্তুত বুধবারই এমন একটা বৈঠক নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তা স্থগিত হয়ে গিয়েছে। এতে কি সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না?
পরিবহণমন্ত্রী এ দিন বলেন, “কথা আছে, ২৭ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে। মুখ্যমন্ত্রী কতটা সময় দিতে পারেন, তার উপরেই সব কিছু নির্ভর করছে।” মন্ত্রীর বক্তব্য, “আমরা কোনও পথ বার করতে না-পারলে সমস্যা বাড়বে। তবে বেসরকারি বাস যদি লাভ করে চালাতে পারে, তা হলে সরকারি বাসকেও সেই রাস্তায় চলতে হবে।” |