ডোবালেও তিনি! ভাসালেও তিনি!
সম্মেলন-পর্বে প্রায় প্রতিটি জেলা কমিটি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে তাঁকে। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে তাড়াহুড়ো, জমি-নীতি তৈরি না-করেই শিল্পের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া, শিল্পায়ন নিয়ে এগোনোর সময় দলের মতামত সব সময় সঙ্গে না-রাখা, শেষ কয়েক বছরে ধারাবাহিক প্রশাসনিক শৈথিল্য, কারণে-অকারণে ক্ষমা চাওয়া চার্জশিটের তালিকা দীর্ঘ।
তবু সেই একই সম্মেলন-পর্বে বক্তা হিসাবে সেই জেলা নেতৃত্বের তরফে চাহিদার বিচারে তিনিই শীর্ষে! সম্মেলন উপলক্ষে সমাবেশ বা প্রতিনিধি অধিবেশন, তাঁর নাম লিখেই আলিমুদ্দিনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে একের পর
এক জেলা।
তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের ‘নৈতিক দায়’ স্বীকার করে যিনি দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইস্তফার পর যিনি সাময়িক ভাবে সরকারি নিরাপত্তা-সহ যাবতীয় বন্দোবস্ত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই দক্ষিণবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলা সম্মেলনে সিপিএমের ‘প্রধান মুখ’ সেই বুদ্ধবাবু (এর মধ্যে শুধু মুর্শিদাবাদ যাননি, সম্মেলনের অল্প আগেই সেই জেলা ঘুরে এসেছেন বলে)। বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কায় আলিমুদ্দিনের ঘেরাটোপে নিজেকে বন্দি করে-ফেলা শুভ্রকেশ প্রৌঢ় আবার জনসমক্ষে এবং দলীয় মঞ্চে হাজির। পুরনো আক্রমণাত্মক কায়দাতেই যিনি আঙুল তুলে বলছেন, ‘মুখ বন্ধ করে থাকব না’! রাজ্য সম্মেলনের পরে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশেও যাঁর অন্যতম বক্তা হওয়ার কথা।
ব্যর্থতার জন্য দোষারোপ যাঁর দিকে, জনগণের রায় যাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে, তাঁকেই সামনে রেখে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র লড়াই? সিপিএমের ব্যাখ্যা সহজ বুদ্ধবাবুর ‘বিকল্প’ এখনও এই সিপিএমে নেই। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক বর্ষীয়ান সদস্যের কথায়, “ভুল হয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু এখনও বুদ্ধবাবুকেই সেরা মনে করে গোটা রাজ্যের পার্টি। তা ছাড়া, ভুলগুলো তো ব্যক্তির নয়। নীতির ভুল। কমিউনিস্ট পার্টিতে ভুল শোধরানোর সুযোগ আছে।”
সিপিএম মনে করতেই পারে, বুদ্ধবাবুর ‘বিকল্প’ নেই। মানুষও কি তা-ই মনে করেন? এর কোনও সূচক হাতের কাছে নেই। বিষয়টি নতুন করে পরীক্ষিতও নয়। কিন্তু বুদ্ধবাবুর উপস্থিতিতে জেলা সম্মেলনগুলির সমাবেশে ভিড়কেই আপাতত বুদ্ধবাবুর ‘গ্রহণযোগ্যতা’র ইঙ্গিত বলে মনে করছে আলিমুদ্দিন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “নেতা হিসাবে কাকে চান, জানতে চেয়ে যে কোনও জেলা কমিটির কাছে সাদা কাগজ ফেলে দিলে তারা এখনও বুদ্ধবাবুর নাম লিখে দেবে! গ্রহণযোগ্যতা না-থাকলে নিশ্চয়ই এটা হয় না! সমাবেশ বা কর্মসূচি আয়োজনে আমাদের সংগঠনের একটা ভূমিকা থাকে ঠিকই। তবুও আমাদের কথা শুনতে মানুষ তো আসছেন।” সাম্প্রতিক কালে সাংগঠনিক ভাবে সিপিএমের কাছে ‘বিপন্ন’ জেলা নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা পূর্ব মেদিনীপুরে বুদ্ধবাবুর সভায় যা ভিড় হয়েছে এবং সমাবেশের মাঝপথে সেই ভিড় যে পাতলা হয়ে যায়নি এই ইঙ্গিতকেই ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ মনে করছে সিপিএম। যার সুবাদে সিপিএম-রাজনীতিতে ফের প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘বুদ্ধ-মাহাত্ম্য’।
দলীয় সূত্রের বক্তব্য, ডাক পেলেও উত্তরবঙ্গ এবং রাঢ় বঙ্গে বুদ্ধবাবু যেতে পারেননি এক দিনে গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভব নয় বলে। শারীরিক কারণেই এক দিনে যাতায়াত সম্ভব নয়, এমন জায়গায় যাওয়া হচ্ছে না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। কলকাতা এবং লাগোয়া দুই জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়ায় সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনে উপস্থিত থেকেছেন। উত্তর ২৪ পরগনাতেও তা-ই হওয়ার কথা। কিন্তু জ্যোতি বসুকে সরিয়ে ২০০১-এর ‘কঠিন’ ভোট যে বুদ্ধবাবুকে সামনে এনে পার হওয়া গিয়েছিল, ২০১১-র বিপর্যয়ের পরেও কি শুধু তাঁকে ধরেই বৈতরণী পেরনোর চেষ্টা চলবে? কমিউনিস্টরা বলে থাকেন, তাঁরা ‘ব্যক্তিনির্ভর’ নন। তা হলে শুধু বুদ্ধবাবুকেই ‘ভরসা’ ধরে থাকতে হচ্ছে কেন? রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “এর একটা প্রক্রিয়া আছে। এখন যেমন অনেকটা সামনে চলে এসেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। ওঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বেড়েছে। সরকারে থাকার সময় যেটা দেখা যেত না। তেমন সুযোগও ছিল না।” প্রসঙ্গত, বুদ্ধবাবু ছাড়া সম্মেলন-পর্বে সব চেয়ে বেশি ডাক পেয়েছেন সূর্যবাবুই। তুল্যমূল্য বিচার করলে, গোটা রাজ্যে ৯টি করে জেলায় সম্মেলনে উপস্থিত থাকার কথা (দু’টি জেলা বাকি) বুদ্ধবাবু ও সূর্যবাবুর।
সিপিএম ফের ‘বুদ্ধ-ভরসা’তেই থাকলেও বামফ্রন্টের অন্দরে অবশ্য কিছু প্রশ্ন আছে। সঙ্গে আছে কিছু দাওয়াই। সিপিআইয়ের এক সাংসদের মতে, “বুদ্ধবাবুর বলার কায়দা একটু বদলানো দরকার। এই যে বলছেন, ‘রাজ্যটাকে তিল তিল করে গড়ে তুলছিলাম’, এ সবের মানে হয় না। ক্ষমতায় থাকার সময় যা বলতাম, বিরোধী আসনে গিয়ে তা বললে মানুষ শুনতে চাইবে না। শুনলেও মানবে না।” আবার আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ওঁর ওই ফোটোক্রোম্যাটিক চশমাটা পাল্টানো উচিত! রোদে কালো হয়ে-যাওয়া কাচের আড়াল থেকে যখন বলেন, দেখতে ভাল লাগে না!”
প্রশ্ন আছে, মানছেন। সমস্যা আছে, মানছেন। সিপিএমের এক কেন্দ্রীয় স্তরের নেতা তবু বলছেন “খুঁত থাকতে পারে। কিন্তু হাতির দাঁত তো! খুঁত আছে বলে হাতির দাঁত ফেলে দেব?” |