অসন্তুষ্ট পঞ্চায়েতের কাজে
পরিবর্তনের ‘কৃতিত্ব’ চেয়ে বার্তা রমেশের
রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র কৃতিত্ব যে তৃণমূলের ‘একচেটিয়া’ নয়, কলকাতায় বসে তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের ‘দূত’ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। তাঁর তিন দিনের বঙ্গ-সফর শেষে বুধবার প্রদেশ কংগ্রেসে দফতরে বসে রমেশ বলেন, “পরিবর্তন কারও একচেটিয়া নয়। এই পরিবর্তনে কংগ্রেসেরও অবদান আছে।”
জয়রামের বক্তব্যকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের প্রতি ‘বার্তা’ হিসেবেই দেখছে কংগ্রেস শিবিরের একাংশ। তাদের ব্যাখ্যা, জোটের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের আবহে নরমে-গরমে মমতাকে ‘বার্তা’ দিয়ে গেলেন রমেশ। যিনি ঘোষিত ভাবেই মমতার সঙ্গে হাইকম্যান্ডের যোগাযোগের ‘সেতু’। এখন দেখার, মমতা-শিবির জয়রামের বক্তব্যকে কী ভাবে নেয়। বিশেষত, যখন বিভিন্ন প্রশ্নে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটে খানিকটা ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে।
বস্তুত, ধানের সহায়ক মূল্যের দাবিতে কৃষক স্বার্থে কংগ্রেসের আন্দোলন, ইন্দিরা ভবনের নামকরণ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে জোটে ‘সংঘাত’ মেটানোও জয়রামের সফরসূচিতে ছিল। কথা ছিল মমতার সঙ্গে বৈঠকেরও। কিন্তু মমতার মণিপুর-সফর ও অন্যন্য কর্মসূচি এবং রমেশের জেলা সফর মিলিয়ে তিন দিনে তাঁদের মুখোমুখি বৈঠক হতে পারেনি। তবে মমতার সঙ্গে তাঁর একাধিক বার ফোনে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
বিধান ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে জয়রাম রমেশ। ছবি: দেবাশিস রায়
দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সফর সেরে এ দিন রাতে দিল্লি রওনা হওয়ার আগে কংগ্রেসকে ‘দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় দল’ এবং ‘দেশের সমস্ত রাজ্যেই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে’ জানিয়ে জয়রাম বলে গিয়েছেন, “আমরা জোটধর্ম পালন করে চলেছি। আমরা এমন কিছু করব না যাতে জোট আঘাতপ্রাপ্ত হয়। জোটকে যথাসম্ভব সম্মান দেব। দেওয়া-নেওয়া করে জোট রাখতে হয়।’’
জয়রামের আরও বক্তব্য, “কংগ্রেস দেশের এ-টিমই।”
সরকারের জোটসঙ্গী হয়েও ধানের সহায়ক মূল্যের দাবিতে কৃষক স্বার্থে আন্দোলনে বা ইন্দিরা ভবনের নামবদলের প্রশ্নে কংগ্রেস পথে নামায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মমতা। কংগ্রেসকে প্রকারান্তরে আবার সিপিএমের ‘বি-টিম’ বলেছিলেন তিনি। জয়রাম এ দিন তারই ‘জবাব’ দিয়েছেন বলে কংগ্রেস শিবিরের ব্যাখ্যা। তাঁর আরও বক্তব্য, “জোটে আছে বলেই কংগ্রেস দল হিসাবে গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে পিছু হটে আসবে, তা নয়।”
পাশাপাশিই জয়রাম জানিয়েছেন, এই ‘রাজনৈতিক টানাপোড়েন’ রাজ্যে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা-সহ গ্রামোন্নয়নের কাজে কোনও প্রভাব ফেলবে না। মমতার সঙ্গে ফোনে আলোচনার কথা জানিয়ে জয়রাম বলেছেন, ফ্লোরাইড-মুক্ত জল প্রকল্পের কাজে আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি আবার পশ্চিমবঙ্গে আসবেন। তখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার চেষ্টা করবেন। এ দিন মমতার সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে এসে রমেশ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমায় বলেছেন, গ্রামোন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করতে তাঁর মন্ত্রী-সচিবরা চেষ্টা করছেন। আমিও বলেছি, গ্রামোন্নয়নে বাংলা যা চাইবে, কেন্দ্র তা-ই দেবে। টাকার কোনও অভাব হবে না।” তবে পাশাপাশি তাঁর সতকর্বার্তা, “কিন্তু সে টাকা কী ভাবে রাজ্য সরকার ব্যবহার করবে, সেটাই প্রধান বিষয়।”
‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্যের গ্রাম-পঞ্চায়েতের কাজ ‘সন্তোষজনক’ নয়। তাঁর কথায়, “নারেগা-র মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। এই প্রকল্প মানুষের কাছে একেবারেই পৌঁছয়নি। রাজস্থান-সহ অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে এই রাজ্য। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার কাজও সন্তোষজনক নয়।” কৃষকরা ধান-গমের ন্যায্য সহায়কমূল্য পাচ্ছেন না অভিযোগ তুলে কংগ্রেস এবং বিরোধী সিপিএম বারবার সরকারকে ‘আক্রমণ’ করছে। ধানের সহায়কমূল্যের দাবিতে পথেও নেমেছে তারা। কিন্তু সরকার সেই অভিযোগকে কার্যত ‘গুরুত্ব’ দেয়নি। উল্টে চেক-এ সরাসরি চাষিদের কাছে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে বলেই দাবি করেছে। তবে সরকারের ‘দাবি’ সত্ত্বেও তিন দিন কয়েকটি জেলা ঘোরার পর জয়রামের বক্তব্য, “কৃষকরা ন্যায্য সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন না। অন্ধ্রপ্রদেশে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধান সংগ্রহ সাফল্য লাভ করেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে যা সম্ভব হয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গেও পরীক্ষা করে দেখতে অনুরোধ করছি। ধান সংগ্রহে বিনিয়ন্ত্রণ হলে অবস্থা কিছুটা বদলাতে পারে বলে মনে হয়।”
কৃষ্ণনগরের হস্তশিল্প মেলায় রাজ্যের দুই মন্ত্রী। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া এবং
তৃণমূলের উজ্জ্বল বিশ্বাস। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
কৃষক-সমস্যার পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে বার্ধক্যভাতাও মানুষ নিয়মিত পাচ্ছেন না বলে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেন জয়রাম। বলেন, “বার্ধক্যভাতা বাবদে কেন্দ্র ও রাজ্য ২০০ টাকা করে মোট ৪০০ টাকা দেয়। জেলায় জেলায় গিয়ে দেখলাম, প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে বয়স্করা পাচ্ছেন না। কয়েক মাস পরে পরে ওই টাকা আসছে।” সেই গাফিলতির জন্য ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’কেই দায়ী করেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, “গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে এই টাকা পৌঁছয় বেশ কয়েকটি দফতর ঘুরে। তার পর দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা ১৮ শতাংশ মানুষের এখনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তাই কয়েক মাস পর যখন এই টাকা আসে, অ্যাকাউন্ট না-থাকায় অনেকেই টাকা পান না। সরাসরি টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। আমি কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।” বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধীদের ভাতাও ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তবে এর মধ্যেও জয়রামকে ‘সন্তুষ্ট’ করেছে রাজ্যের ব্লক স্তরের প্রশাসনে তারুণ্যের উপস্থিতি। তিনি বলেন, “এখানে অনেক তরুণ বিডিও দেখলাম। অন্য সব রাজ্যে তো বৃদ্ধ বিডিও দেখি। তরুণ প্রশাসক থাকায় পঞ্চায়েত স্তরের কাজ ভাল হবে আশা করি।” আনুষ্ঠানিক ভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যের মাওবাদী অধ্যুষিত তিন জেলায় গ্রামোন্নয়নের কাজ সরেজমিনে দেখা। পাশাপাশি দেখা, ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে জোট কী ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’ এনেছে। তাঁর বক্তব্য, “আগে বাম জমানায় একদলীয় শাসন চলত। অন্য দলকে কাজ করার সুযোগই দেওয়া হত না। এখন সেই অবস্থার অনেকটাই বদল হয়েছে।” সে দিক দিয়ে তিনি সরকারের খানিকটা ‘প্রশংসা’ও করেছেন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে যে কাজের মান ‘সন্তোষজনক’ নয়, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার, মুখ্যমন্ত্রী জয়রামের জোড়া বক্তব্যের, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কী প্রতিক্রিয়া জানান।
স্বনির্ভর গোষ্ঠার মাধ্যমে ধান কেনার আর্জি। বলরামপুরের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ধান কেনার কাজে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে নামানোর পরামর্শ দিলেন কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। তাঁর বক্তব্য, “অন্ধ্র, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশার সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধান কেনে। এই রাজ্যেও সেই পদ্ধতি শুরু হোক।” বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যান পুরুলিয়ার মাওবাদী উপদ্রুত বলরামপুরের ঘাটবেড়া ও মণ্ডল-কেরোয়া গ্রামে। মণ্ডল-কেরোয়া গ্রামের চাষিদের অভিযোগ, এ বছর ভাল ধান হলেও বিক্রি করতে গিয়ে তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন। মিলছে না সরকারি সহায়ক মূল্য। অভিযোগ শুনে জয়রাম পুরুলিয়ার জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহের কাছে চাষিদের সহায়ক মূল্য না পাওয়ার কারণ জানতে চান। জেলাশাসক জানান, ওই চাষিরা প্রশাসনের স্থানীয় ভাবে বিক্রি করেছেন। তাই সহায়ক মূল্য পাননি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.