স্কুলে আচমকাই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে মেয়েটি। পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল, পাশ করেছে বটে, কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কোনওক্রমে। ‘কেন রে, এ বার এমন হল কেন?’ শিক্ষকের প্রশ্নে বুড়ো আঙুল দিয়ে নাগাড়ে মাটি খুঁড়ে গিয়েছিল নবম শ্রেণির ছাত্রীটি। উত্তর মেলেনি।
সে দিন এড়িয়ে গেলেও দিন কয়েক পরে ওই শিক্ষকের দরজায় গুটি গুটি কড়া নেড়েছিল নবম শ্রেণির দীপা দাস। ‘কী রে!’ দরজা খুলতেই কেঁদে ফেলেছিল মেয়েটি।
প্রতিবাদী দীপা। নিজস্ব চিত্র |
তার পর কালীনারায়ণপুর আদর্শ বিদ্যালয়ে তার প্রিয় শিক্ষক সিদ্ধার্থ দত্তের কাছে ধীরে ধীরে মেলে ধরেছিল তার অভিযোগ, “মা জানিয়ে দিয়েছেন, ঢের হয়েছে পড়াশোনা। এ বার বিয়ে দিয়ে দেব। আর টানতে পারছি না তোকে।” নাবালিকা মেয়েটি বেঁকে বসেছিল, ‘এখনই বিয়ে নয়’ বলে। কিন্তু মা শুনলে তো!
তোর কি বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে? সিদ্ধার্থবাবুর প্রশ্নে আমতা আমতা করে দীপা জানিয়েছিল, ঠাকুমা বৃন্দাবনে পাত্র দেখে এসেছে। বিয়ে একরকম পাকা। আর দেরি করেননি ওই শিক্ষক। সে দিনই দীপাকে নিয়ে সটান হাজির হয়েছিলেন রানাঘাটের মহকুমাশাসক সুমন ঘোষের কাছে। মেয়েটির কান্না আর পড়াশোনার নাছোড় ইচ্ছে দেখে ভাল লেগেছিল সুমনবাবুর।
তিনি বলেন, “ওই শিক্ষক আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন মেয়েটিকে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি আমাকে জানায়, বিয়ে নয়, আরও পড়তে চায় সে। সংসারে দায়দায়িত্বও নিতে চায়। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওর জেদ দেখে। আমি স্থানীয় বিডিওকে মেয়েটির বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।”
কালীনারায়ণপুর স্টেশন থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে টিনের একচালা বাড়ি দীপাদের। বছর দশেক ধরে তার বাবার কোনও খোঁজ নেই। দুই ছেলে, মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে সংসারটা টানেন দীপার মা মমতাদেবী। তিনি জানান, কোনওরকমে ভিক্ষা করে সংসার চলে। একচিলতে ঘরে বসেই দীপা বলে, “কখনও বিধাননগর, কখনও ব্যারাকপুরে ঘুরে ভিক্ষা করে মা। তাতেই যা ৫০-৬০ টাকা হয়। সংসার চলে তাতেই। তার মধ্যেও পড়াশোনা করছিলাম। আমার ইচ্ছে বাড়ির এই দুরবস্থা দূর করার। তাই পড়তে চাই।”
মমতাদেবী অবশ্য বলেন, “বিয়ের তেমন পাকা কোনও কথা হয়নি। আসলে ওর ঠাকুমা বৃন্দাবনে গিয়ে দীপার জন্য ছেলে দেখেছিলেন। আর তাতেই ওর ভয় ঢুকে গিয়েছে।” দীপা অবশ্য বলে, “কিছু দিন ধরেই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল মা-ঠাকুমা। শুধু তাই নয়, দিন কয়েক আগে বিয়ের জন্য আমাকে চাকদহে মামার বাড়িতেও রেখে এসেছিল মা। সেই চাপ মাথায় নিয়ে এ বার পরীক্ষার ফলও খারাপ হয়েছে।”
দীপার পড়শি জানকীনাথ দাস বলেন, “কিছুদিন ধরেই দীপাকে দেখতে পাত্র পক্ষের আসা-যাওয়া চলছিল। কিন্তু মেয়েটা কান্নাকাটি করত। ওইটুকু মেয়ে এখনই বিয়ে করবে কি?”
বিডিও দিব্যেন্দুশেখর দাসও বাড়ি এসে বুঝিয়ে গিয়েছেন দীপার মা’কে। তিনি বলেন, “স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে যাতে নিয়মিত চাল, গম ওঁরা পান তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এত পড়াশোনার ইচ্ছে। স্কুলের সঙ্গেও কথা বলছি, যাতে নিখরচায় পড়তে পারে মেয়েটি।” |