অনেক দিন পরে গ্র্যান্ড স্লাম সেমিফাইনালে প্রথম চার বাছাইকেই দেখা যাচ্ছে। টেনিসের সর্বোচ্চ মানের পক্ষে এটা ভাল বিজ্ঞাপন। অস্ট্রেলিয়া ওপেনে বুধবার জকোভিচ স্ট্রেট সেটে ডেভিড ফেরারকে এবং অ্যান্ডি মারেও তিন সেটে মেলবোর্নের ওপেন যুগে প্রথম জাপানি হিসেবে শেষ আট পর্যন্ত এগনো নিশিকোরিকে হারানোয় পুরুষ সিঙ্গলসে সেমিফাইনাল লাইন আপ চূড়ান্ত হয়ে গেল। এক জকোভিচ বনাম চার মারে। দুই নাদাল বনাম তিন ফেডেরার। এর মধ্যে বৃহস্পতিবারই, আমাদের একটা ছুটির দিনে শীতের দুপুরে রাফা বনাম রজার মহাম্যাচটা টিভিতে উপভোগ করতে পারব ভেবে আরও ভাল লাগছে। এবং এ বার আমার বাজি ফেডেরার। নাদাল শেষ দু’টো ম্যাচে অসাধারণ খেলেছে। দুর্দান্ত মুভ করছে গোটা কোর্ট। সব সত্যি। কিন্তু ফেডেরারও তুখোড় ফর্মে রয়েছে মেলবোর্নে। সেই আগের মতো একের পর এক অনবদ্য উইনার মেরে ঝুড়ি-ঝুড়ি পয়েন্ট তুলছে। কোয়ার্টার ফাইনালে দেল পোত্রোর মতো অলরাউন্ড প্লেয়ারকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। ফিটনেস, শরীরী ভাষা, ক্লান্তি এগুলো দু’জনের মধ্যে বিচার করলেও ফেডেরারকে ভাল জায়গায় দেখাচ্ছে। নাদালকে শেষ দু’টো ম্যাচ যেখানে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে জিততে হয়েছে। ফেডেরার তখন প্রতিটা ম্যাচই এখন পর্যন্ত সহজে জিতেছে। ফলে তুলনায় অনেক তাজা অবস্থায় নাদালের সামনে থাকবে। সেক্ষেত্রে ফেডেরারের তিরিশের বেশি বয়সটাও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। কিংবদন্তি রড লেভারের প্রথম ‘গ্র্যান্ড স্লাম’ করার অর্ধশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের পরের দিনই তাঁর নামেরই স্টেডিয়ামে টেনিস ইতিহাসের অন্যতম মহাযুদ্ধ! |
আবার জকোভিচ এ দিন পিঠের যন্ত্রণাকে পাত্তা না দিয়ে যে ভঙ্গিতে ‘বুল ডগ’ ফেরারকে হারাল তাতে সেমিফাইনালে মারে-ই আমার মতে আন্ডারডগ। গোটা কোর্ট সারাক্ষণ চষে ফেলার অদম্য ক্ষমতার জন্য সার্কিটে ফেরারকে ‘বুল ডগ’ ডাকা হয়। সে রকম প্রতিপক্ষকেও ‘জোকার’ এক রকম উড়িয়ে দিল ৬-৪, ৭-৬ (৭-৪), ৬-১। চোট-টোটের ছিটেফোঁটা চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না জকোভিচের খেলায়। মারে অবশ্য আরও সহজে ৬-৩, ৬-৩, ৬-১ হারিয়েছে নিশিকোরিরকে। তবু গ্র্যান্ড স্লামে ‘সামিট’ ম্যাচের অতীত পারফরম্যান্স মাথায় রাখলে রবিবার মেলবোর্নে পার্কে ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা ফেডেরার এবং জকোভিচের। এবং সেটা হলে সেখানেও আমি বাজি ধরব ফেডেরারে ওপর।
মেয়েদের সিঙ্গলসে বরং ফাইনাল তো কোন ছার, বৃহস্পতিবার সেমিফাইনালেও কে কাকে হারাবে বলা মুশকিল। পুরুষদের সার্কিটে প্রথম ২৫-৩০ জন প্লেয়ারের মধ্যেও প্রথম চার বা পাঁচজনের সঙ্গে বাকিদের স্কিল, ধারাবাহিতকার তফাতটা স্পষ্ট। যেটা মেয়েদের সার্কিটে এই মুহূর্তে নেই। এক-দেড় দশক আগে তো বটেই, এমনকী সেরেনা-জাস্টিন এনা-ভেনাসদের টপফর্মেও বিশ্বের এক বা দুই নম্বরের সঙ্গে বাকিদের তফাতটা বেশ বোঝা যেত। কিন্তু এখন র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম আট-দশ জন মেয়ের যে কেউ অন্যকে যে কোনও দিন হারিয়ে দিতে পারে। মেয়েদের সার্কিটের মানটা এমনই খানিকটা নেমে গিয়েছে! যার প্রধান কারণ, সেরা মেয়েদেরও খেলায় ধারাবাহিকতার অভাব। যে কারণে সানিয়া মির্জার পক্ষে কোনও ছোটখাটো টুর্নামেন্টে (গ্র্যান্ড স্লামে হবে না, কেননা সর্বোচ্চ মঞ্চে প্রথমসারির প্লেয়াররা সব সময় অন্য লেভেলে নিজেদের খেলাকে তুলে নিয়ে যায়।) কোনও দিন হয়তো ক্লিস্টার্স বা আজারেঙ্কাকে হারিয়ে দেওয়াও সম্ভব। কিন্তু সোমদেব দেববর্মন কোনও দিন কোথাও নাদাল বা মারেকে হারাতে পারবে না।
মেলবোর্নে প্রথম সেমিফাইনালে ক্লিস্টার্স খেলবে আজারেঙ্কার সঙ্গে। পরে শারাপোভা বনাম কিভিতোভা। শেষ তিন জনই বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর আসনের দিকে দৌড়চ্ছে। ওদের মধ্যে যে-ই শনিবার ট্রফিটা হাতে ধরবে, তার দু’দিন বাদেই সরকারি ভাবে বসে পড়বে ওজনিয়াকির ছেড়ে যাওয়া আসনে।
বরং ভারতীয়দের ডাবলস-অভিযানে কার পক্ষে শেষমেশ ট্রফি পাওয়া সম্ভব সেটা বলা খানিকটা সহজ। টুর্নামেন্ট সেমিফাইনালে পৌঁছে গেলেও চার ভারতীয়ই এখনও টিকে আছে। এটা বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের বিচারে খুবই ইতিবাচক দিক ভারতীয় টেনিসের পক্ষে। রাদেক স্টেপানেককে নিয়ে এ দিন লিয়েন্ডার পেজ পৌঁছে গেল ডাবলস সেমিফাইনালে। অবাছাই এবং দু’জনের বয়সের যোগফল ৭০। কিন্তু চিরসবুজ লিয়েন্ডারের সেই অবিশ্বাস্য নাছোড় মনোভাব আর টেনিস খেলাটার প্রতি অদম্য প্রেম! যা ওকে কোর্টে এই ২০১২-তেও চ্যাম্পিয়ন-সুলভ করে রেখেছে! টেকনিক্যাল দিক দিয়ে বলব, এই নতুন জুড়ির দু’জনই দারুণ ভাল ভলি মারতে পারে। সনাতনী ডাবলস টিম সার্ভ-ভলি টেনিসে নিঁখুত। এ দিন সে ভাবেই খেলে বাছাই মার্কিন-ব্রাজিলীয় জুড়ি বুটোরাক-সোয়ারেজকে ৬-৪, ৭-৬ (৭-৪) হারাল। আজ বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা জুড়ি ম্যাক্স মির্নি-ড্যানিয়েল নেস্টরের সঙ্গেও লিয়েন্ডারদের একটা প্রচণ্ড লড়াই দেখব যে, নিশ্চিত। একই দিনে লিয়েন্ডার-ভেসনিনার ইন্দো-রুশ জুড়ির মিক্সড ডাবলস কোয়ার্টার ফাইনালও পড়েছে ইন্দো-মার্কিন জুড়ি রোহন বোপান্না-লিজা রেমন্ডের বিরুদ্ধে। যে ইভেন্টে খাঁটি ভারতীয় জুটি মহেশ-সানিয়া এ দিন সেমিফাইনাল পৌঁছে গিয়েছে। লিজেল হুবার-কলিন ফ্লেমিংকে ৭-৬ (৭-৫), ৬-২ হারিয়ে। আর লিয়েন্ডার-ভেসনিনা এ দিন ৬-৩, ৭-৫ হারায় মাটকোস্কি-সু উইকে। তবে মেয়েদের ডাবলসে সানিয়া-ভেসনিনা প্রথম বার গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলার সোনার সুযোগ নষ্ট করল। কুজনেৎসোভা-জোনারেভার মতো তারকা জুটির বিরুদ্ধে মীমাংসাসূচক তৃতীয় সেটে ৪-১ এগিয়ে থেকেও স্রেফ প্রচুর (গোটা ম্যাচে ৫১টা) ‘আনফোস্র্র্ড এরর’ করে হেরে গেল ৬-৭ (৪-৭), ৬-২, ৪-৬। মনে হচ্ছে, মিক্সড ডাবলসে ভারতীয়দের ট্রফি পাওয়ার সম্ভাবনা এ বার সবচেয়ে বেশি। এবং সেটা কারা বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। |