‘অবৈধ’ ট্রামকর্মীর অপমৃত্যু ঘিরে শুরু হল তরজা
‘অবৈধ’ নিয়োগের প্রশ্ন তুলে রাজ্যের নয়া সরকার কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)-র যে ২৫৮ কর্মীর বেতন তিন মাস আটকে রেখেছে, তাঁদের এক জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হল। বিক্রম সিংহ (২৮) নামে ওই যুবকের ঝুলন্ত দেহ মঙ্গলবার তাঁর কোন্নগরের ভাড়াবাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। বাড়ির লোকের অভিযোগ, তিন মাস বেতন না-পেয়ে অর্থকষ্টেই তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে কর্মীমহলে যেমন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তেমন রাজনীতির মহলেও শুরু হয়েছে চাপান-উতোর।
সিটিসি-সূত্রের খবর: ২০১০-এর ডিসেম্বরে বিক্রম হাওড়ার ঘাসবাগান ডিপোয় অস্থায়ী কর্মীর কাজ পান। তখন বেতন পেতেন সাড়ে চার হাজার টাকা। বিয়েও করেন। তাঁর বাবা ও দাদা রাজমিস্ত্রি। গত মে মাসে ভোটের ঠিক আগে বিক্রমের চাকরি পাকা হয়, বেতন বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার। কিন্তু গত অক্টোবরের পর আর বেতন পাননি তিনি। কেন? সিটিসি-র চেয়ারম্যান শান্তিলাল জৈনের বক্তব্য, “উনি বিধানসভা ভোটের সামান্য আগে ঘাসবাগান ডিপোয় খালাসি পদে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। পরে দেখা যায়, সিটিসি-র যে ২৫৮ জনের নিয়োগ বেআইনি ভাবে হয়েছে, তিনি তাঁদেরই এক জন। এঁরা শেষ বেতন পেয়েছেন অক্টোবরে।”
বিক্রমের মৃত্যুর খবরে সিটিসি-র কর্মীমহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, “আমাদের কাছে ট্রাম কোম্পানির স্থায়ী কর্মীর নিয়োগপত্র রয়েছে। এর পরেও সরকার অবৈধ বলে কী করে?” তাঁর প্রশ্ন, “যাঁদের নিয়ম না মেনে চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে সরকার ঘোষণা করেছে, তাঁদের বরখাস্ত করা হচ্ছে না কেন? ওঁদের কাজ করিয়ে টাকা না-দেওয়াটা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ!”
এ দিকে বিষমদ খেয়ে মৃতদের পরিবার যদি ক্ষতিপূরণ পায়, তা হলে সিটিসি-র স্থায়ী কর্মীর মৃত্যুতে রাজ্য কেন ক্ষতিপূরণ দেবে না, বিক্রমের পরিবার সেই প্রশ্ন তুলেছে। তাঁর বাবা মন্টু সিংহ বুধবার বলেন, “সরকার তো বিষমদে মৃতদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। আমাদেরও যদি ক্ষতিপূরণ এবং ওর বকেয়া পাওনাটা দেয়, তা হলে অন্তত ওর স্ত্রী বাঁচতে পারে।” সিটিসি-র চেয়ারম্যান অবশ্য জানাচ্ছেন, “আমাদের সংস্থার তরফে মৃতের পরিবারকে বিশেষ কোনও সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে পরিবহণ দফতর কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা রূপায়িত করা হবে।”
একের পর এক কৃষকের অপমৃত্যুর জেরে রাজ্য সরকার এখন এমনিতেই কিছুটা চাপে রয়েছে। সিপিএম তো বটেই, সরকারের শরিক কংগ্রেসও কৃষক-মৃত্যু নিয়ে রীতিমতো সরব। এরই মধ্যে পরিবহণ-কর্মীর এই অপমৃত্যু সিপিএমের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “ওই যুবক চার-পাঁচ মাস বেতন পাননি। তিনি অবসাদের শিকার হয়েছিলেন। এই আত্মহত্যা মর্মান্তিক।” প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী তথা সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, “এটা আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত খুন। সরকার ছ’মাস বেতন দেয়নি! বলছে, ভর্তুকি বন্ধ করে দেব!” পরিবহণ-কর্মীদের কাছে তাঁর আহ্বান, “শ্রমিকের পথ আত্মহত্যার পথ নয়। শ্রমিকেরা ব্যারিকেড গড়ে তুলুন। প্রয়োজনে আন্দোলন করে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করুন।”
অন্য দিকে রুগ্ণ সরকারি পরিবহণ নিগমে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পক্ষে মঙ্গলবার মহাকরণে বসে জোরালো সওয়াল করেছিলেন যিনি, এ দিন সিটিসি-কর্মীর অপমৃত্যুর খবর শোনার পরে সেই পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের সুর ছিল অনেকটাই নরম। তাঁর কথায়, “খুবই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা। এই মৃত্যু নিয়ে নানা কুৎসা রটছে। এর তীব্র বিরোধিতা করছি। এমন কুৎসা অমানবিক কাজ। রাজ্য ওই পরিবারকে সাহায্য করবে।” রাতে মদনবাবু রিষড়ায় বিক্রমের পৈতৃক বাড়িতে যান। পরিবারকে কিছু আর্থিক সাহায্যও করেন।
স্বামী হারিয়ে। নিজস্ব চিত্র
বিক্রমের পরিবার তাঁর মৃত্যুর দায় রাজ্য সরকারের উপরে চাপিয়েছে। মৃতের স্ত্রী কুমকুম এ দিন বলেন, “ক’মাস ধরে বেতন পাচ্ছিল না। সংসার চলছিল না। দোকান-বাজারেও অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল। সেই হতাশা থেকেই ও আত্মহত্যা করল।’’ পড়শিদেরও একই বক্তব্য। কুমকুম জানাচ্ছেন, “ক’মাস আগে অফিসের কো-অপারেটিভ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। তা-ও শেষ। আরও হতাশ হয়ে পড়ে।” বিক্রমের বন্ধু, ঘাসবাগান ডিপোর কর্মী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অফিসের পরিস্থিতি ভাল নয়। আমি ছোটখাটো কাজ করে চলাই। ওর অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। দু’দিন আগেই পাঁচশো টাকা দিয়েছিলাম।”
পরিজনেরা জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার সকাল দশটা নাগাদ অভিজিতবাবুর সঙ্গেই কাজে গিয়েছিলেন বিক্রম। বেলা দু’টো নাগাদ ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েন। বিকেলে কুমকুমকে মুড়ি আনতে বলেন। কুমকুম বলেন, “ঘরের বাইরে কাজ করছিলাম। দোকানে যাওয়ার আগে ঘরের জানলার দিকে তাকাতেই দেখলাম, ও ঝুলছে।” কুমকুমের চেঁচামেচিতে বাড়ির লোক ও পড়শিরা ছুটে আসেন। শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা বিক্রমকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ দেহ ময়না-তদন্তে পাঠায়। সিটিসি-র ঘাসবাগান ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেন, “মঙ্গলবার অফিসে এসে কয়েক ঘণ্টা ছিল। দুপুরের দিকে হেড অফিসে গেল। বলছিল, মনটা ভাল নেই, ক’দিন ছুটি নেব। একেবারে ছুটি হয়ে গেল!”
অন্য দিকে বিক্রমের মৃত্যু ঘিরে এ দিন রাজনীতিকদের ‘তৎপরতা’ও ছিল চোখে পড়ার মতো। সকালে এলাকায় রটে যায়, বিক্রম সিপিএম কর্মী। তাতে অবশ্য তৃণমূলের ‘উদ্যোগ’ কমেনি। ময়না-তদন্ত থেকে শুরু করে ম্যাটাডর ভাড়া করে দেহ রিষড়ার বাড়িতে পাঠানো আগাগোড়া তদারক করেন শ্রীরামপুরের তৃণমূূল নেতা অন্বয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে পরিবহণমন্ত্রী সকাল থেকে যোগাযোগ রাখছিলেন। মদনবাবু ফোনে বিক্রমের মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন।
শ্রীরামপুর ওয়ালশ থেকে এ দিন বিক্রমের দেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর রিষড়ার বাড়িতে। সেখান থেকে রিষড়া রবীন্দ্রভবনে। দলের জেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় কোঙার, শ্যামল চক্রবর্তী, প্রাক্তন মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী প্রমুখ। বিক্রমের দেহ দলীয় পতাকায় ঢেকে দিতে উদ্যোগী হন স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীরা। সেই পতাকা তাঁরা বিমানবাবুর হাতেও তুলে দিতে চাইছিলেন। বিমানবাবু দলীয় কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হন, বিক্রম দলের কেউ নন। সিটু-র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না। সিপিএম নেতারা তাঁর দেহে শুধু মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। তার পর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঘাসবাগানে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.