|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ফেলে রাখো এক কোণে |
‘ওকে মেরো না। মারলে ও অমর হয়ে যাবে।’
অতএব শর্মিলাকে ঢেকে দেয় এক দেশ উপেক্ষা। একটি নাটক দেখলেন
তাপস সিংহ |
শ্রীমতী: সৈন্যবাহিনী সরে যাক। নিরুপদ্রবে যে মানুষ চায় সে এসে দিক পূজা এই স্তূপে। পরমকারুণিকের পদতলে এক বার বসবে যে কেউ, এতে তো কারও কোনও ক্ষতি ঘটে না রাজা!
অজাতশত্রু: একটু বোঝাই তোমাকে শ্রীমতী, ভেবে দেখো, কী ভয়ানক কর্ম তুমি করেছ এবং সেই যে তুমি ভিতরে ভিক্ষুণীর বেশ পরে উপরে নর্তকীর গহনা পরে নৃত্য করলে, তার পরে জানা গেল স্পষ্ট যে এটি পূজা, নাচ নয়, তখনই কিন্তু তোমাকে হত্যা করার কথা। কিন্তু, এখনও তুমি শ্বাস নিচ্ছ, উপবাস করছ, দেহে আছে প্রাণ, সেটা তো আমি দয়া করেছি বলে!
|
নটীর পূজা! কৌশিক সেনের নির্দেশনায় এই নতুন নাট্যের সংলাপ যেন বড্ড চেনা চেনা মনে হয়! না, রবীন্দ্রনাথের চির-চেনা গদ্যনাটকে এই সংলাপ নেই। কিন্তু, ‘রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত’ স্বপ্নসন্ধানী-র এই নাট্য কখন যেন খুঁজে নেয় তার নিজস্ব সংলাপ। তার আগে পর্যন্ত অবশ্য পরতে পরতে মিল মূল নাটকের সঙ্গে। কিন্তু অশোকবনে নটী শ্রীমতীকে নাচতে হবে, এই রাজাদেশের পরেই ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে নাটকের গতিপথ! যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে আর এক জীবননাট্য, আর তার সংলাপগুলিও চেনা লাগে! আরও এক গভীর গোপন অন্তরালবর্তিনীর কথা মনে পড়িয়ে দেয় এই নাট্য!
অন্তরালে থেকেও সেই নারী বড় বেশি প্রকাশ্য! তাঁর কথা আপাতত থাক, আমরা নটীর কাছে যাই। |
|
শ্রীমতী: আপনি যখন বুঝলেন তখনই আমাকে হত্যার আদেশ দিলেন না কেন?
অজাতশত্রু: না, আমি তো রাজা। আমি তো হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমাকে বর্তমান ভাবতে হয়, ভবিষ্যৎ ভাবতে হয়। রাজা উদাসীন নয় শ্রীমতী।
(শ্রীমতী আচমকা হাসতে শুরু করে। হাসি দেখে ভয়ার্ত হয়ে পড়েন অজাতশত্রু।)
শ্রীমতী: আপনি যদি তখনই আমাকে হত্যার আদেশ দিতেন, হতেও পারে বুদ্ধের শ্রবণেরা খেপে গিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারত। এই ভয় পেয়েছিলেন রাজা? আসলে রাজা উদাসীন থাকে, যাতে মানুষ জয় কালীকরালীর নামে হানাহানি চালাতে পারে। ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষ যখন খেপে ওঠে, তখন রাজা কী ভাবে আনবেন স্থিরতা? তাই তাঁকে বুদ্ধি করে যুদ্ধ করে সব কিছু বিশৃঙ্খল রেখে দিতে হয়।
অজাতশত্রু: তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয় শ্রীমতী!... তুমি যদি আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চাও, আমাকে বল। আমি তোমাকে ব্যবস্থা করে দেব। আমি তোমাকে আলোকবৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসব। গোটা মগধবাসী জানবে অজাতশত্রু কত উদার! কিন্তু তোমার ওই নিভৃত উপবাসকে আমি ভয় পাই।
|
যেমন গোটা দেশ জানে, ভারতীয় গণতন্ত্র কত উদার! সে দয়া করেছে বলেই না সেই সুদূর মণিপুরে বসে বছরের পর বছর অনশন চালিয়ে যেতে পারছেন ইরম শর্মিলা চানু! নটী শ্রীমতী চেয়েছিল, অশোকবনের উপাসনাস্থল থেকে সরে যাক সৈন্যদল, মানুষ নির্বিঘ্নে পুজো দিক সেখানে। আর কবি শর্মিলা চেয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করা হোক। আর একটু সুরক্ষিত হোক মানবাধিকার। চানুর অনশন শুরু হয় ৫ নভেম্বর ২০০০ সন্ধ্যা থেকে।
এর একটি প্রেক্ষাপট আছে। ওই বছরেরই পয়লা নভেম্বর সেনাবাহিনীর উপরে হামলা চালায় মণিপুরি জঙ্গিদের একটি গোষ্ঠী। পাল্টা হিসেবে ইম্ফলের মালোম বাস স্ট্যান্ডে অষ্টম অসম রাইফেলস গুলি চালালে ১০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৬২ বছরের এক বৃদ্ধা ও ১৮ বছরের সিনম চন্দ্রমণি। ১৯৮৮ সালে শিশুদের মধ্যে সাহসিকতার জন্য জাতীয় পুরস্কার পায় সিনম। সংবাদপত্রে দেহগুলির ভয়াবহ ছবি দেখে অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা। তার পর থেকে বহু বার তাঁর অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেছে সরকার। তিনি নতিস্বীকার করেননি।
প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে— ২৮ জানুয়ারি আরও চারটি রাজ্যের সঙ্গে মণিপুরেও হতে চলেছে বিধানসভা নির্বাচন। গণতন্ত্রের এই কুচকাওয়াজের আঙিনায় সেই নারীর ঠাঁই কোথায়? দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর এই অনশন সমাজকে কী শিক্ষা দিল? অণ্ণা হজারের ক’দিনের অনশন ঝড় তোলে জাতীয় রাজনীতির আঙিনায়, ‘মিডিয়া অ্যাটেনশন’-এর কেন্দ্রে বারে বারে আসেন অণ্ণা। দিনের পর দিন অচল সংসদ! কত তর্ক, অণ্ণার পোস্টার, মুখোশ আর টুপির কত না বিক্রি...
আর সেই মেয়ে? সে যে সরকারি হেফাজতে হাসপাতালের শয্যায়। তবু ‘রাজা’ তাঁকে হত্যা করবে না। ঢেকে দিতে চাইবে উপেক্ষার ধুলোয়!
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যরূপ কী বলছে?
|
অজাতশত্রু: শ্রীমতী, তোমার চোখের জ্যোতি নিভে আসছে, গাত্রে দুর্গন্ধ, জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে তোমার, তুমি ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত শরীর, শরীর বোঝ শ্রীমতী? শরীর? তোমার রূপ-যৌবন তোমায় ত্যাগ করবে অচিরেই, তোমার মেঘের মতো চুলের ফাঁকে খেলা করবে কীটের দল, চামড়া খসে পড়বে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ঘৃণায় তুমি পড়ে থাকবে একটি ‘প্রান্তিক’ নিঃসঙ্গ একাকী তরণীর মতো হালভাঙা, পাল ছেঁড়া এক তরণী, যে ভেসে চলে গহীন সমুদ্রে তার পর ঢেউ তাকে খুঁজে পাবে না।’
শ্রীমতী (আকাশের দিকে মুখ তুলে): আমি অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি। এ বার তোমায় দেখতে পাচ্ছি। আমার আর ক্ষুধা নেই, আর তৃষ্ণা নেই।
|
তার পর মহারাজের দিকে ফিরে হাত জোড় করে নটী।
|
শ্রীমতী: হয়তো আপনিই তথাগত। আপনাকে প্রণাম।
অজাতশত্রু: ওকে বাঁচিয়ে রাখ। ওকে মের না। ওকে মারলে ও অমর হয়ে যাবে। ওকে ফেলে রাখ এক কোণে। দেখবে, মানুষ আস্তে আস্তে ওকে ভুলে যাবে।
|
শ্রীমতীকে একটু একটু করে ঢেকে দিতে থাকে সময়। মগধ রাজ্য এগিয়ে চলে। এখনও স্তূপমূলে রয়েছে সৈন্যবাহিনী। আর কী আশ্চর্য, সকলে ভুলে গেলেও এখনও শ্রীমতী জীবিত।
শর্মিলাকে ঢেকে দিতে থাকে উপেক্ষা। দেশ এগিয়ে চলে। এখনও রদ হয়নি সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন। আর কী আশ্চর্য, সকলে ভুলে গেলেও এখনও জ্বলজ্বল করছে শর্মিলার চোখ! |
|
|
|
|
|