|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
প্রজাতন্ত্র এবং বাজার
নাগরিক হয়ে ওঠা |
সম্ভব, যদি প্রজা আরও সচেতন হয়, আরও সঙ্ঘবদ্ধ।
বাজারে ক্রেতার ভূমিকা থেকে প্রজাতন্ত্রের অন্য এক পাঠ নিয়েছেন
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায় |
প্রজাতন্ত্র’ কথাটির দু’রকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে প্রজার তন্ত্র এবং প্রজার জন্য তন্ত্র। আমাদের দেশের প্রজাতন্ত্র অবশ্যই প্রজার জন্য তন্ত্র। ভোটের মাধ্যমে প্রজারাই তো বেছে নেন দেশের শাসককে। সুতরাং সেই প্রজাদের ভোটের কথা মাথায় রেখেই নিজেদের কর্মসূচি ঠিক করে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল। ভোটের আগে শাসক, বিরোধী সমস্ত দলই সম্ভব, অসম্ভব নানা রকম প্রতিশ্রুতির ঝুলি নিয়ে নেমে পড়ে ময়দানে। শাসক দলের লক্ষ্য প্রজাদের আরও সুযোগসুবিধে দিয়ে তার সরকারের প্রতি জনসমর্থন অটুট রাখা, আর বিরোধীদের লক্ষ্য, নজরকাড়া ‘প্যাকেজ’-এর বন্যা বইয়ে আরও বেশি জনসমর্থন নিজেদের দিকে টেনে আনা।
কিন্তু প্রজার ‘তন্ত্র’ বা প্রজার নিয়ন্ত্রণ? সেই বস্তুটি আমাদের মতো দেশে খুবই দুর্বল। কারণ, এখানে প্রজারা ভোট দেন কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে। যে দলের প্রতিশ্রুতি তাঁদের কাছে বেশি গ্রহণীয় বলে মনে হয়, তাঁরা তাদেরই ভোট দেন। কিন্তু আমরা, প্রজারা শাসকের বা বিরোধীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তার যথেষ্ট উপায় আমাদের হাতে থাকে না। বিভিন্ন দল যে সব প্রার্থীকে আমাদের সামনে সাজিয়ে দেয়, যা যা প্রতিশ্রুতি বা প্রকল্প পেশ করে, আমরা তার থেকেই পছন্দ বেছে নিতে বাধ্য হই। নিজেদের ‘অপশন’ বলে কিছু আমাদের থাকে না।
ভেবে দেখলে, আমাদের প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের বাজারের কিন্তু একটা বড় মিল আছে। বাজার অবশ্যই ক্রেতার জন্য। বাজার নানা পণ্য তৈরি করে সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে, দাম ঠিক করে এমন ভাবে যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের ঘরে পৌঁছে যেতে পারে, গুণগত মানকে এমন ভাবে পেশ করে যাতে চট করে নজর টানে নির্দিষ্ট পণ্য। পণ্যের উদ্ভাবন থেকে শুরু করে ক্রেতার চৌকাঠ ডিঙোনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আক্ষরিক অর্থে আমজনতাকে মাথায় রেখে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এক প্রজন্ম আগে পর্যন্ত ত্বকচর্চার সামগ্রী বলতে বাজারে পাওয়া যেত কয়েক ধরনের ক্রিম, পাউডার, স্নো ইত্যাদি। ত্বকের ধরন অনুযায়ী (শুষ্ক, তৈলাক্ত না সাধারণ) ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার, ফাউন্ডেশন, সানস্ক্রিন, ফেয়ারনেস ক্রিম এত বৈচিত্র পাওয়াও যেত না, সাধারণ মহিলারা ত্বক নিয়ে এত মাথাও ঘামাতেন না। খুব সীমিত সংখ্যক কোম্পানি বাজারে একচেটিয়া অধিকার বজায় রেখেছিল। কিন্তু আজ যদি বলা হয় ত্বকচর্চার দুনিয়ায় একটা বিপ্লব হয়ে গিয়েছে, অত্যুক্তি হবে না। সদ্যোজাত শিশু থেকে সত্তরোর্ধ্ব মহিলা বা পুরুষ যে কোনও বয়সের, যে কোনও ত্বকের প্রসাধনী হাজির এই বাজারে। নামী বিদেশি ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে ঘরোয়া আয়ুর্বেদিক, উচ্চবিত্তদের জন্য ঝাঁ চকচকে প্যাকেজিং থেকে শুরু করে প্রধানত স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি স্যাশে পছন্দ অফুরন্ত। |
|
‘অপশন’। |
এবং এই বাজারে তিন বছরের শিশু থেকে পঞ্চাশের প্রৌঢ় শামিল সবাই। একটা সময় ছিল যখন বাচ্চাদের গরুর দুধ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ানোর কথা চিন্তাই করা হত না। আস্তে আস্তে অল্প কিছু কোম্পানি দুধে মিশিয়ে খাওয়ার জন্য দু-চারটে নতুন হেলথ ড্রিঙ্ক নিয়ে এল বাজারে। এখন বাজারে হেলথ ড্রিঙ্ক অসংখ্য। ফ্লেভারের ক্ষেত্রে অধিকাংশরই রয়েছে নানা রকমভেদ। বিজ্ঞাপন-প্রভাবিত বাচ্চা নিজেই ঠিক করছে সে এ মাসে স্ট্রবেরি ফ্লেভার কিনবে, না ভ্যানিলা। শপিং মল থেকে পাড়ার দোকান সর্বত্র চেনা ছবি। বাজারে খরিদ্দার কেবল লক্ষ্মী নয়, এখন মহালক্ষ্মী।
কিন্তু বাজারে ক্রেতার মত, ক্রেতার অধিকার, ক্রেতার দাপট কি দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? উত্তর: না। রাজনীতির মতোই, এখানেও কিন্তু আমাদের নিজস্ব ‘অপশন’-এর সুযোগ আসলে খুব কম। বিভিন্ন কোম্পানি যে ভাবে কোনও পণ্য পেশ করছে, আমরা সেটাই, সেই ভাবেই গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার দাবি বা পছন্দ অনুযায়ী আসলে তারা চলছে না, বরং তাদের মর্জি, তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ।
তবে এটাও ঠিক যে, বাজারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ছে ধীরে ধীরে, অন্তত এক শ্রেণির ক্রেতার মধ্যে। এঁরা নিয়মিত বাজারে যান, কোন পণ্য বাজারে এল বা কোন পণ্য বাতিল হল সে বিষয়ে খবরাখবর রাখেন, পণ্য কেনার আগে ওজন ঠিক দেওয়া হচ্ছে কি না দেখে নেন এবং মোড়কের গায়ে আটকানো লেবেল (এতে প্রতিটি উপকরণের অনুপাত দেওয়া থাকে, যাতে ক্রেতা নিজেই যাচাই করে নিতে পারেন) খুঁটিয়ে পড়েন। শুধু তা-ই নয়, পণ্যসংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে এখন কোনও ক্রেতা যদি কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে চান, তার উত্তর দিতে বাধ্য থাকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। ১৯৮৬ সালের ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন’ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ক্রেতার ছ’টি অধিকার। পণ্য এবং পরিষেবা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানানোর জন্য তৈরি হয়েছে ‘কনজিউমার ফোরাম’। ফলে আজকের গ্রাহকদের কাজ শুধু দোকান থেকে জিনিসটা কেনা নয়, তার গুণাগুণ বিচার এবং প্রয়োজনে আইনের সাহায্য নেওয়ার দায়িত্বও তাঁরই। ক্রেতারা এখন অনেক বেশি স্বাবলম্বী বলেই কয়েক বছর আগে কোকাকোলা এবং পেপসির মতো বারোটি সংস্থার নরম পানীয়তে বিষাক্ত কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়ার খবরে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। চাপে পড়ে নানা রকম সংশোধনী ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিল দুনিয়ার প্রথম সারির বহুজাতিক সংস্থাগুলি।
আর সেই সূত্রেই মনে হয়, এই একই ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রেও। প্রথমেই দরকার নাগরিক হিসেবে যে অধিকারগুলি আমার প্রাপ্য, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। এই অধিকার যদি আমরা না পেয়ে থাকি, তা হলে দরকার প্রতিবাদের, প্রয়োজনে আন্দোলনের। সাম্প্রতিক ভারতেই তার নমুনা আমরা দেখেছি। জমি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন পরিবর্তন এনেছে সরকারের জমিনীতিতে, রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পর কলকাতার নাগরিক সমাজের প্রতিবাদে কিছুটা হলেও কমেছে পুলিশের এক্তিয়ার-বর্হিভূত হস্তক্ষেপ, অণ্ণা হজারের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন ঢোঁক গিলতে বাধ্য করেছে সরকারকে। হয়তো ফলাফল সব সময় তাৎক্ষণিক হবে না, কিন্তু নিরন্তর চাপ বজায় রাখতে পারলে ক্রমে ন্যায্য অধিকার পাওয়া যাবে। প্রজাতন্ত্র তখন কেবল প্রজার জন্য না থেকে, প্রজার তন্ত্রও হয়ে উঠবে। প্রজা হয়ে উঠবে নাগরিক। |
|
|
|
|
|