|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
কী পাওয়ার কথা, কত দিনে, কত মঞ্জুর হল |
জানলে মানুষই রুখে দিতে পারে দুর্নীতি। গণতন্ত্রের শক্তি আমরা ভুলতে বসেছি। লিখছেন
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাতী ভট্টাচার্য |
যে দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে, সেই দেশ প্রজাতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দেশে সেই ইচ্ছার প্রকাশ ও রূপায়ণ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। ক্ষোভ দেখা দেয় যখন জনপ্রতিনিধিরা সেই ইচ্ছার মর্যাদা দেন না। যেখানে গরিব ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, নেতা-আমলারা বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করে, তেমন দেশকে ‘আমার দেশ’ বলে মেনে নেব কেন? সেই রাগেই লক্ষাধিক ভারতবাসী এক স্বল্প-পরিচিত, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের সঙ্গে অনশনে বসলেন, স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হলেন। তাগিদ ছিল তীব্র, প্রকাশও হয়েছে জোরালো। এ বার চিন্তার প্রয়োজন মানুষের মূল ইচ্ছাটি নিয়ে। দুর্নীতি দূর হোক, এই যদি হয় দেশের মানুষের চাহিদা, লোকপাল আইন পাশের দাবিই কি তা পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়?
|
এত দুর্নীতি কেন |
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি উত্তরপ্রদেশের বিধায়কদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা গিয়েছিল, যাঁদের ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নিজের বা পরিবারের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে,’ তাঁরা প্রায় ৪০ শতাংশ। ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নতুন ব্যবসা কিংবা ঠিকাদারির কাজ শুরু হয়েছে বা বেড়েছে’ ৫৪ শতাংশের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন অন্তত ৪২ শতাংশ। সংখ্যাগুলি খানিকটা অনুমান-ভিত্তিক, তবু এ-ও ঠিক যে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতে দুর্নীতি দ্রুত বেড়েছে। লোকপাল আইন হলে বহু সাংসদ বেকায়দায় পড়বেন। জেলের টিকিট কে-ই বা কাটতে চায়? |
|
এই সাংসদদের খুব বেশি দোষও দেওয়া চলে না। সবাই জানে, ভোটে লড়তে যে বিপুল টাকা লাগে তার কোনও বৈধ উৎস অধিকাংশ প্রার্থীই দেখাতে পারবেন না। ভোটের আগে প্রকাশ্যে টাকা বিলি হয় বহু রাজ্যের নির্বাচনে। টাকাগুলো আসে কোথা থেকে? যে কোনও সাংসদ ধরেই নেন, তাঁর দল আইনের বাইরে গিয়েও তাঁর জন্য টাকা তুলবে। আর নির্বাচনের জন্য যখন টাকা তুলতেই হচ্ছে, তখন যারা টাকা তুলছে তারা যে কিছু টাকা নিজের পকেটে পুরবে, তাতে কি আশ্চর্য হওয়া চলে? সাংসদ নিজে সৎ হলেও তাঁকে পার্টির তোলা টাকার উপর নির্ভর করতেই হবে। তাই কোন সাংসদ সৎ আর কে অসৎ, বিচার করে লাভ হয় না। সাংসদ নির্বাচনের যে ব্যবস্থা বহাল, সেটাই দুর্নীতিকে অবধারিত করে তোলে।
|
বিকল্পের সন্ধান |
নির্বাচনে দুর্নীতি রোধ করা যায় কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় কর্পোরেটগুলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী খরচ দেয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট যেমন রায় দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, যে কোনও কোম্পানি তার পছন্দের দলকে যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারে, যদি তারা তা খোলাখুলি ঘোষণা করে দেয়। ভারতে (বা ফ্রান্স-জার্মানিতে) ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হবে, একে পয়সা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো বলেই ধরে নেবেন অনেকে। কেউ হয়তো বলবেন, দল যখন টাকা নেবেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, তখন লুকোছাপা না করে খোলাখুলি বলতে দোষ কী? অন্য পক্ষ আপত্তি করবেন, কে কাকে কত দিচ্ছে, সে তথ্য এত জটিল যে তা জানিয়ে দিলেও হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তের পক্ষে তার তাৎপর্য উদ্ধার কঠিন।
ভারতে অন্য সংস্কারের কথা ভাবা যায়। যেমন, রাষ্ট্রই নির্বাচনে প্রচারের খরচ দিক প্রতি রাজ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি (বা তিনটি বা পাঁচটি) রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের। টাকার অঙ্ক না হয় দরাজ ভাবেই ঠিক হোক। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো, টাকা ঢেলে টাকার অপচয় আটকাতে হবে। অবশ্যই এই প্রস্তাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে: নতুন দলগুলোর কী হবে? বিধানসভা নির্বাচনের টাকা কে দেবে? উত্তর খোঁজা দরকার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের খরচে স্বচ্ছতা আনতে টাকা দিতে হবে রাষ্ট্রকে, এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জরুরি।
লোকপাল আইন নিয়ে আপত্তি একেবারে গোড়ায়। এ আইনের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র সম্পর্কে অণ্ণা হজারের ধারণা: ‘রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। তাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যতটা সম্ভব ভয়ে রাখা, চাপে রাখা দরকার।’ কিন্তু রাষ্ট্রকে যতই নির্মম মনে হোক, শেষ অবধি তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় সেতু তৈরি হবে, পানীয় জল পরিস্রুতির সেরা উপায় কী, শিক্ষা নীতি কী হবে। সরকারের কাজ হয়তো আরও সরল, আরও সীমিত করা যেতে পারে। কিন্তু তার পরেও বহু কাজ থেকে যাবে, যা সরকারকেই করতে হবে, এবং ভাল করে করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়লেই যে অন্য কাজগুলো আরও ভাল ভাবে হয়ে যাবে, এমন নয়। বরং লোকপাল ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে জানলে সরকারি কর্মীদের কম টাকায় ভাল কাজ করানোর উদ্যোগটাই চলে যাবে। সরকারি টাকা বাঁচানোর ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না।
সরকারি দফতরগুলোয় বজ্র-আঁটুনি কষতে গিয়ে ফস্কা-গেরো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে তহবিলের টাকা, এমন দেখা গিয়েছে অনেকে দেশে। যেমন, ইতালিতে সরকারি কর্তারা দু’ভাবে জিনিস কিনতে পারেন। এক, সরকার-নির্দিষ্ট সরবরাহ সংস্থা ‘কনসিপ’-এর থেকে। কনসিপ ঘোষিত দামে জিনিস দেবে, ঘুষ দেবে না। দুই, বাজার থেকে সরাসরি দরদাম করে, সে ক্ষেত্রে ঘুষ খেয়ে বরাত পাইয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইতালি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে পরিচিত, সেখানে সরকারি কর্তারা বাজার থেকে জিনিস কিনতে আগ্রহী হবেন, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা কনসিপ থেকেই কিনছেন, বাজারের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দাম দিয়েও। অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে গা বাঁচাতে। অকারণ ব্যয়ের ফলে ইতালি সরকারের মোট জাতীয় উৎপাদনের দুই শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। লোকপালের কড়াকড়িতে ভারতেও এমন ঘটতে পারে।
|
নজরদারির রকমফের |
সরকারি দফতরের উপর নজরদারি অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে সব দেশে আমলাতন্ত্র কাজ ভাল করে, সেখানে দেখা যায় কর্মীরা নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রকের চেয়ে দফতরের ভিতরের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছেন বেশি। বাইরে থেকে কেবল দেখা যায় অমুক নিয়মটা মানা হচ্ছে না। ভিতরের লোকেরা বোঝে কে নিয়মের এ দিক ও দিক করছে কাজটা আরও দ্রুত করার জন্য, আর কে তা করছে নিজের পকেট ভরার জন্য। কী করে সেচের কাজ ঠিক সময়ে হবে, পোস্ট অফিস আর একটু ভাল কাজ করবে, তার উত্তর লোকপালের কাছে নেই। বরং যে দক্ষ, সৎ লোকগুলো এ সব কাজ করতে পারতেন তাঁরা দমে যাবেন। লোকপাল কাজে লাগবে সেই রাঘববোয়ালদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, যাঁরা আইনকে পরোয়া না করেও পার পেয়ে যান।
কেবল ঘুষখোরকে শাস্তি দিয়ে স্বচ্ছ, দক্ষ ও তৎপর প্রশাসনের দাবি পূরণ করা যাবে না। বাড়ির সামনে মরা কুকুর পচছে, পুরসভার কর্মী তুলে নিয়ে যাচ্ছেন না। শিক্ষক মাইনে পাচ্ছেন, ক্লাসে আসছেন না। এগুলোও দুর্নীতি, যা ঘুষের চেয়ে বেশি বিপন্ন করে সাধারণ মানুষকে। প্রাপ্য যথাসময়ে না পেলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। অথচ এ দেশে যা পাওয়ার কথা তা পাওয়া একটা বিরল ঘটনা। একটা বড় কারণ, কোন পরিষেবা কার, কোন সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা, স্পষ্ট করে জানানো হয় না নাগরিকদের। ২০০৭-এ পশ্চিমবঙ্গের রেশন রোষে স্পষ্ট হয়েছিল যে, গ্রাহকদের কত চাল-গম কোন দরে পাওয়ার কথা, ক’দিন খোলা থাকার কথা রেশন দোকান, তা অনেকে জানেন না। ফলে ‘সাপ্লাই আসেনি’ বলে পার পেয়ে যান ডিলাররা, গ্রামবাসী জানেন না কোথা থেকে তার সত্যতা জানা যাবে। তাই কোন ডিলারটা চোর, শুধু সেটা খুঁজে লাভ নেই। বদলাতে হবে ব্যবস্থাটাই।
একটা উপায়, নাগরিকদের কী কী প্রাপ্য, কোন শর্তে, তা স্পষ্ট জানানোর পদ্ধতি তৈরি করা। বহু রাজ্যে তৈরি হয়েছে ‘নাগরিক সনদ’ (সিটিজেন্স চার্টার), নাগরিকদের অধিকারগুলি যেখানে বিশদে বলা হচ্ছে। যেমন, জমির নথির জন্য আবেদন করলে কত দিনের মধ্যে দফতর তা দিতে বাধ্য। এর ফলে সরকারি দফতরগুলোর অদক্ষতা বোঝার একটা মাপকাঠি আসে নাগরিকদের হাতে, তাই চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও বাড়ে। এ দেশে সেটা হতে দেন না সরকারি কর্মীরাই। বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে তথ্যগুলি তাঁরা অস্পষ্ট করে রাখেন, আর প্রায়ই বদলান, ফলে ধন্দ তৈরি হয়। মিড ডে মিল প্রকল্পটি যে অন্য অনেক প্রকল্পের তুলনায় নিয়মিত ও কার্যকর তার একটা কারণ এটার বিষয়ে কোনও ধন্দ নেই। সকলেই জানেন, স্কুল খোলা থাকলেই মিড ডে মিল পাওয়ার কথা প্রতিটি ছাত্রের, এবং তার দায়িত্ব মাস্টারমশাইদের।
আমজনতার কাছে তথ্য প্রকাশের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকলে সেই চাপে দুর্নীতিও কমে আসে। উগান্ডায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর অনুদান পাঠাত স্কুলগুলির জন্য, কিন্তু বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নেতা-আমলারা বেশির ভাগই আত্মসাৎ করতেন। শেষে সরকার কোন স্কুলে কত অনুদান গেছে, খবরের কাগজে ছেপে দিতে লাগল। হাতে হাতে ফল: ’৯৫ সালে স্কুলগুলোয় গড়ে বার্ষিক অনুদানের ২৪ শতাংশ টাকা পৌঁছত, ২০০১-এ পৌঁছল ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দেশে যদি নিয়মিত জানানো হত কোন ব্লকে রেশনে কত চাল এসেছে, বা সেচ বা রাস্তা তৈরির খাতে পঞ্চায়েতে কত টাকা এসেছে, তা হলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার দরকার হত না। ব্যবস্থার চাপে দুর্নীতি কমত।
নেতাদের ইচ্ছা যখন মানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে না, তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে জনস্বার্থের বিরোধ বাধবে না পদে পদে, তখন সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য শাসনতন্ত্র।
|
শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|