|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
শুধু মা কেন |
শিশু কেবল তাহার পরিবারের সম্পদ নহে, সে রাষ্ট্রের সম্পদ। তাহার যথাযথ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। তাই অষ্টাদশ বৎসর প্রাপ্তির পূর্বে শিশুর জন্য তাহার মাতাকে দুই বৎসরের ছুটি লইবার অধিকার দিয়া শিশু অধিকারের দিক হইতে সরকার যথাযথ কাজ করিয়াছে। চিকিৎসা, পরীক্ষা কিংবা অন্যান্য নানা কারণে শিশুর প্রতি পরিবারের সদস্যদের যে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, তাহা রাষ্ট্র স্বীকার করিয়াছে, এবং তাহার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়াছে। কিন্তু অন্যায় একটি ঘটিয়াছে-- এই ছুটিতে কেবলমাত্র মায়ের অধিকার রাখা হইয়াছে। ইহার ফলে রাষ্ট্র যে বার্তাটি পাঠাইয়াছে তাহা হইল, শিশুপালনের দায়িত্ব মহিলাদের, পুরুষদের উপর সেই দায় বর্তায় না। ইহা পুরুষতন্ত্রের সাবেকি ধারণা, রাষ্ট্র বিনা বিতর্কে ইহা গ্রহণ করিয়া দেশবাসীকে বিস্মিত করিয়াছে। অনেকে দাবি করিতে পারেন, শিশুর জীবনে মায়ের স্থানই কেন্দ্রে, তাহাকেই অধিক প্রয়োজন সন্তানের। অতএব মায়ের ছুটির দাবিকে অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। অনেকে ইহার সপক্ষে জীবনবিজ্ঞানের নানা সাক্ষ্যও দেখাইবেন।
এই আপত্তি গ্রহণযোগ্য নহে। সদ্যোজাত শিশুর ক্ষেত্রে মাতাকে অধিক প্রয়োজন থাকিতে পারে, মাতৃত্বের ছুটির কয়েক মাস তাই এই সময়টির জন্য উপযোগী। কিন্তু সন্তানের অষ্টাদশ বর্ষ পর্যন্ত সমগ্র শৈশব-কৈশোর কেবল মা-কেই তাহার সকল দায়-দায়িত্ব পালন করিতে হইবে, এই ধারণা একান্ত অসঙ্গত। ইহাতে পুরুষরাও আপত্তি করিতে পারেন, কারণ পুরুষরা সন্তান-পালনে অনুপযুক্ত, রাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত আপত্তিজনক। আজ ভারতে অধিকাংশ পরিবারই অণু-পরিবার, যৌথ পরিবার নহে। তাই পিতা-মাতা সন্তানের দায়-দায়িত্ব সমান ভাবে ভাগ করিয়া লইতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিতেছেন। রাষ্ট্রের এই পশ্চাদমুখী সিদ্ধান্তের ফলে এই লিঙ্গসাম্য প্রতিহত হইলে। ‘তুমি ছুটি পাইবে, তাই তোমাকেই করিতে হইবে’ বলিয়া সন্তানপালনের দায় মায়ের উপরে চাপাইবার এই সুযোগ রাষ্ট্রই তৈরি করিয়া দিল। অথচ ইহার প্রয়োজন ছিল না। সন্তান-পিছু মোট দুই বৎসরের ছুটি দুই অভিভাবকের যে কেহ প্রয়োজন অনুসারে ভাগাভাগি করিয়া লইতে পারিবে, অথবা কোনও একজন লইতে পারিবে, এই নিয়ম করিতে বাধা ছিল না।
এ দেশে যে আইন অধিকাংশ নাগরিকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, সেই হিন্দু নাবালকত্ব এবং অভিভাবকত্ব আইন অনুসারে আজও মাতাকে শিশুর ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ বলিয়া স্বীকার করে না। যদিও লেখক গীতা হরিহরণের একটি মামলার রায় দিতে গিয়া সুপ্রিম কোর্ট নানা বিষয়ে মাতার সমানাধিকার স্বীকার করিয়াছে, কিন্তু আইনটি সংশোধন করিয়া মাতাকে পূর্ণ এবং স্বাভাবিক অভিভাবকের মর্যাদা আজও দেওয়া হয় নাই। আদালত যে স্বীকৃতি দিয়াছে সমাজ তাহার সামান্যই স্বীকার করিয়াছে। বহু মহিলাকে অসুখী দাম্পত্য, কিংবা শ্বশুরগৃহে নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছে, এবং আজও হয়, কেবল মাত্র তাহার সন্তানটির নাগাল পাইবার জন্য। রাষ্ট্র মহিলাদের মাতৃত্বের মর্যাদা আজও দেয় নাই, কিন্তু দায়টি কেবলমাত্র তাহাদের উপরেই চাপাইতেছে, ইহা কি পুরুষতন্ত্রের নবপরিচয় নহে? মহিলারা যদি বাহিরের কাজ সমান উদ্যমে করেন, তাহা হইলে সন্তানপালনের কাজে পুরুষ অংশগ্রহণ করিবে না কেন? এই নিয়ম পরবর্তী প্রজন্মের নিকটও ভুল বার্তা পৌঁছাইবে। যে সামাজিক অন্যায় বহু যুগ ধরিয়া ঘটিয়া আসিতেছে, তাহাকে নবকলেবরে প্রকাশ করিয়া রাষ্ট্র অধিক অন্যায় করিল। |
|
|
|
|
|