|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
চমৎকারতন্ত্র |
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তবে বাষট্টি বৎসর বয়ঃক্রম হইল। এই বাষট্টিতম জন্মবার্ষিকীটি তাহার লজ্জায় অধোবদন রূপে অতিবাহন করা উচিত। যে সকল প্রতিশ্রুতি সঙ্গে করিয়া এই প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হইয়াছিল, এই সপ্তাহের জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনের প্রেক্ষিতে তাহা মনে করিয়া তীব্র আত্মগ্লানি বোধ করা উচিত। কোনও সাহিত্যিককে তাঁহার সাহিত্যকর্মের জন্য নির্বাসিত করিয়া রাখিতে পারে যে স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদী গুণ্ডাদের প্রাণঘাতী হুমকির সামনে ব্যক্তিমানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে না যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাহার জন্য এই লজ্জা, এই গ্লানিই ধার্য। জনবহুলতম গণতন্ত্রের দেশ বলে বিশ্বময় ভারতের বিরাট কদর। প্রতিটি দেশবাসীর জানা জরুরি যে ভীরুতম গণতন্ত্র বলিয়াও তাঁহাদের দেশের নামডাক কম নহে। নামডাক এই জন্যই যে, এ বারের জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনের ক্ষেত্রটিই তো প্রথম নহে, অনেক বার অনেক ক্ষেত্রে শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের ভারতীয় রাষ্ট্র যথার্থ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। সেই দীর্ঘ তালিকা হইতে তুলিয়া সাম্প্রতিক একটি নাম এই প্রসঙ্গে করিতেই হয় মকবুল ফিদা হুসেন। হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমণের আশঙ্কায় শিল্পী হুসেন দেশে ফিরিতে পারেন নাই। আর এ বারে, আক্রমণাত্মক মুসলিম মৌলবাদীদের জন্য বিশ্ববিখ্যাত লেখক সলমন রুশদি এ দেশে পা রাখিতে পারিলেন না।
এমনকী ভিডিয়ো-ছবি মারফত তাঁহার সাক্ষাৎকারের প্রস্তাবটিও শেষ পর্যন্ত বাতিল করিতে হইল। রুশদির ছবি দেখাইলেও নাকি মারপিট দাঙ্গার সম্ভাবনা! চমৎকার পরিস্থিতি! এইটুকু ব্যবস্থাও কি কোনও প্রশাসনের পক্ষে করা সম্ভব নহে? পর্দায় ছবি দেখানো হইয়াছে, এই অভিযোগে যাহারা গুন্ডামি ভাঙচুর করিবে, তাহাদেরও কি প্রশাসনিক বল প্রয়োগ করিয়া ‘শাসন’ করা সম্ভব নহে? তবে প্রশাসন নামক বস্তুটি রহিয়াছে কী জন্য? জনগণের ইচ্ছানুযায়ী, দুর্জন-গণের অভিসন্ধি অনুযায়ী দেশ চালাইবার জন্য? রাজস্থানের প্রাদেশিক সরকার, দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার, সর্ব স্তরেই তবে প্রশাসন কথাটির অর্থ হইল প্রকৃষ্টরূপে পিঠ বাঁচাইয়া শাসন? নীতি, আদর্শ, ঔচিত্য ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠিয়া যে পথ সহজ, সুবিধাজনক, সে পথ ধরিয়াই চলা? প্রসঙ্গত, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত সোজাসুজি জানাইয়া দিয়াছেন, রুশদি বুকার পুরস্কারে ভূষিত হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহাকে ওই শহরে আহ্বান করিবার প্রশ্নই নাই! মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলিবার থাকিতে পারে: ধন্য স্পষ্টভাষণ!
রাষ্ট্র যদি নিজেকে বারংবার এমন মেরুদণ্ডহীন প্রমাণ করে, তবে জনসাধারণ এবং দুর্জনসাধারণ তাহাকে নিজেদের সুবিধাক্রমেই ব্যবহার করিতে চাহিবে, সন্দেহ নাই। এ বিষয়েও সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভিপ্রায় বিষয়েও সংশয় উপস্থিত হইবে। কত বার কেহ যুক্তি দিতে পারে যে, ‘প্রকৃতপক্ষে অভিপ্রায় অন্যতর হইলেও আমি অবস্থাগতিকে এমনতর করিতেছি’! ইতিমধ্যেই ইতিউতি গুঞ্জন, আসলে সমগ্র বিষয়টিই সরকারি অঙ্গুলিহেলনে ঘটিতেছে। প্রত্যহ এমন ভাবে মৌলবাদীদের নিত্যনূতন হুমকি শিরোধার্য করিয়া চলিলে তো এই গুঞ্জন অস্বীকার করিবার পথটিও বন্ধ হইয়া যায়! সমগ্র দেশের শাসকসমাজের আর এক বার গোড়া হইতে বিষয়টি ভাবিয়া দেখা উচিত। ভাবিয়া দেখা উচিত, কোনও শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য তাঁহার ব্যক্তি-অস্তিত্বকে এ ভাবে শাস্তি দান করা কোনও গণতন্ত্রের পক্ষে সঙ্গত কাজ কি না। নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত: আর কত দিন এই অসঙ্গত সুবিধাবাদিতা চলিবে? |
|
|
|
|
|