সময় থাকতে সাবধান হও! পরিচিত-অপরিচিত মেয়েদের ডেকে এখন এ কথাই বলছেন ওঁরা। সময় থাকতে সাবধান না-হওয়ার যে মাসুল নিজেরা গুনছেন, তা যাতে অন্যদের না গুনতে হয়, তাই অশক্ত শরীরেও ঘুরছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে অন্য ডাক্তারের চেম্বারে।
পরিবারে তিন জন ক্যানসারে মারা যাওয়ার পরেও ক্যানসার সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতা তৈরি হয়নি ওঁদের। এমনকী, স্তন ক্যানসারের মতো যে ক্যানসারের প্রাথমিক অস্তিত্ব নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করে বোঝা সম্ভব, তা-ও করতেন না তাঁরা। বৃদ্ধ বয়সে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দুই বোন এখন তারই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করছেন এই রোগের সচেতনতার প্রচার করে।
|
মমতা ও মন্দিরা। ছবি: দেবাশিস রায় |
চার বোনের গল্প। মন্দিরা, মমতা, মণিমালা আর মঞ্জুলা। ছোট বোন মঞ্জুলার ক্যানসার ধরা পড়েছিল ১৯৯৭ সালে। তখন অসুখ অনেকটা ছড়িয়ে গিয়েছে। ৯৮ সালে ওই রোগেই তাঁর মৃত্যু হয়, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। দুই পিসি ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। এক জনের ক্যানসার হয়েছিল লিভারে, অন্য জনের গল ব্লাডারে। পরিবারে তিন জনের একই মারণ রোগে মৃত্যু ওঁদের কষ্টের বোঝা বাড়ালেও সচেতনতা বাড়ায়নি এক চুলও। তাই বড় বোন মন্দিরার স্তনে যখন একটা মাংসপিণ্ড দেখা দিল, তখন সেটাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেননি ওঁরা। কিছু দিন আগে সেই মাংসপিণ্ডকেই ক্যানসার বলে রায় দিলেন চিকিৎসকেরা এবং জানালেন অসুখ অনেকটাই ছড়িয়েছে। মন্দিরাদেবী বলেন, “টিউমার যে হয়েছে, বুঝেছি অনেক আগেই। কিন্তু গা করিনি। কোনও ব্যথা ছিল না। তাই ভেবেছিলাম নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া এমন একটা জায়গায় টিউমার নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সঙ্কোচও ছিল।”
এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ধরা পড়ল আর এক বোন মমতার স্তন ক্যানসার। চিকিৎসকেরা তাঁকে দেখেও একই কথা জানালেন এবং বললেন, “আরও আগে বোঝা উচিত ছিল!”
ওঁরা বোঝেননি, যেমন অনেকেই বুঝতে চান না। আর তাই রোগ ক্রমশ শিকড় গাড়ে শরীরে। দুই বোনের চিকিৎসক, এনআরএসের রেডিওথেরাপির প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “পরিবারে কারও ক্যানসার থাকলে বাকিদের যে সচেতন থাকা উচিত, সেই বার্তাটা অনেকের কাছে পৌঁছয়নি। এই পরিবার তারই একটা জ্বলন্ত ছবি।”
হরিদেবপুরের বাসিন্দা মন্দিরাদেবীর অবশ্য অভিযোগ, শুধু সাধারণ মানুষ নন, চিকিৎসকদের অনেকেই এই রোগের উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন নন। কারণ, বছর কয়েক আগে অন্য সমস্যা নিয়ে পরিচিত এক শল্যচিকিৎসকের কাছে যান তিনি। ওই চিকিৎসককে তাঁর স্তনের মাংসপিণ্ডের কথা বলা সত্ত্বেও তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। বরং হোমিওপ্যাথির পরামর্শ দেন। মন্দিরাদেবী বলেন, “ওই ডাক্তারের কথা শুনে বিষয়টা নিয়ে আমার অবহেলা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর দুই আগে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার স্তন থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। মাঝেমধ্যে রসও গড়াচ্ছে। তখন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
তড়িঘড়ি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরে মন্দিরাদেবী বুঝতে পারেন, আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল। তার পরে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির লম্বা প্রক্রিয়া। সে সব শেষ হতে না হতেই ধরা পড়ল মমতাদেবীর স্তন ক্যানসার। তাঁরও একই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা।
মন্দিরা আর মমতা, সত্তর ছুঁইছুঁই দুই বৃদ্ধা এখন পরস্পরের বড় সহায়। কেউই বিয়ে করেননি। ওঁরা এখন অন্যদের সহায় হতে চান। আশপাশে তো বটেই, ক্যানসার হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে অল্পবয়সী মেয়েদের দেখলেই সাবধান করেন। যেখানে ক্যানসার রোগীর সঙ্গে তাঁদের বাড়ির মহিলাদের দেখতে পান, ডেকে বলেন, “নিজের চেক-আপ করাচ্ছো তো?” আর কী বলছেন? মন্দিরাদেবী বলেন, “প্রতি দিন নিজের স্তন পরীক্ষা করা উচিত, কোনও মাংসপিণ্ড হচ্ছে কি না। যদি হয়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখানো উচিত। স্তনবৃন্ত থেকে রস বা রক্ত বেরোলেও অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো জরুরি। অবিবাহিতা ও নিঃসন্তান মহিলাদের বেশি সাবধান থাকা উচিত।”
ঠেকে শিখেছেন ওঁরা। অন্য বোন মণিমালা সোম তাই এখন খুব সাবধানী। তিনি নিজে ও তাঁর মেয়ে নিয়মিত চেকআপ শুরু করেছেন। মণিমালাদেবীর কথায়, “কেন আমাদের সাবধান থাকা উচিত, এই সত্যটা আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে বুঝছি। তাই আর ভুল করতে চাই না।” |