গ্রেফতার আরও দুই কর্তা
মানসিক নির্যাতন করেছে পুলিশ, অভিযোগ আমরি-কাণ্ডে ধৃতদের
সোমবার সকালে আমরি অগ্নিকাণ্ড মামলায় হাসপাতালের আরও দুই কর্তাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। তার পর আদালতে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সরব হলেন আমরি-কর্তাদের আইনজীবীরা।
আমরি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হাসপাতালের ‘নাইট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ সাজিদ হোসেনকে এ দিন তাঁদের কলকাতার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আদালতে অভিযুক্তের আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, এর আগে লালবাজারে জেরার সময় তাঁদের উপরে পুলিশ পরিকল্পনামাফিক ‘মানসিক নির্যাতন’ করেছে। বারবার লালবাজারে ডেকে পাঠিয়ে জেরা করলেও ওই দুই আমরি-কর্তাকে কেন এত দিন গ্রেফতার করা হয়নি, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
সরকারি তরফে অবশ্য আমরি-কর্তাদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডের তদন্তের সময় ওই দুই কর্তার নাম উঠে এসেছে। কিন্তু গোটা বিষয়টির মধ্যে বিস্তর আইনি জটিলতা রয়েছে। সেই কারণে প্রত্যেককে গ্রেফতার করার আগে তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে হচ্ছে।
এ দিন গ্রেফতার হওয়া সাজিদ হোসেনের বিরুদ্ধে মৃতদের পরিবারবর্গের অভিযোগ, ঘটনার দিন তিনি রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের হাসপাতালে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। ফলে সাজিদ গ্রেফতার হওয়ায় মৃতদের আত্মীয়রা খুশি।
ধৃত আমরি-কর্তা পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাজিদ হোসেন। নিজস্ব চিত্র
আমরি-কাণ্ডে এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাত জন ডিরেক্টর। পরিচালন বোর্ডের ১৫ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র সাত জনকে গ্রেফতার করায় পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে আগেই আদালতে প্রশ্ন তুলেছেন আমরি-কর্তাদের আইনজীবীরা। এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হল ‘মানসিক নির্যাতনের’ অভিযোগ।
এ দিন আলিপুরের পঞ্চম বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট শাহনওয়াজ হোসেনের আদালতে পৃথাদেবীর আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লালবাজারে তাঁর মক্কেলকে বসিয়ে রাখা হত। বছর পঞ্চান্নর ওই প্রৌঢ়ার উপর ‘মানসিক নির্যাতন’ চালায় পুলিশ। আমরি-র ডিরেক্টরদের গাফিলতিতেই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এমন কথা পৃথাদেবীকে দিয়ে ‘বলিয়ে’ নেওয়ার চেষ্টা হয়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয়ও দেখানো হত। তাতে লাভ না হওয়ায় পৃথাদেবীকে গ্রেফতার করা হল বলে আদালতে অভিযোগ করেন অশোকবাবু। সাজিদ হোসেনের আইনজীবী অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়, সেলিম রহমানও একই অভিযোগ তোলেন।
অভিযুক্তদের আইনজীবীরা দাবি করেন, আমরি-তে আগুন কী ভাবে লাগল বা প্রত্যক্ষ ভাবে ওই ঘটনার জন্য কে দায়ী, তা এখনও বুঝতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারীরা আগে জানিয়েছিলেন, হাসপাতালের ডিরেক্টররাই ওই ঘটনার জন্য দায়ী। এখন আবার অভিযোগ তোলা হচ্ছে হাসপাতাল কর্মীদের বিরুদ্ধেও।
অন্য দিকে সরকারি আইনজীবী শক্তি ভট্টাচার্য বলেন, আমরি-র ডিরেক্টরদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল ওই দুই হাসপাতাল কর্তার। প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্ব ছিল তাঁদেরই উপর। শক্তিবাবু বিচারককে জানান, দমকলকে বারবার হলফনামা দিলেও আমরি-র বেসমেন্ট থেকে ‘ফার্মাসি’ সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হননি পৃথাদেবীরা। তাঁদের গাফিলতির জন্যই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দু’পক্ষের সওয়াল শুনে বিচারক জামিনের আবেদন খারিজ করে দুই অভিযুক্তকেপুলিশ হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। ৩০ জানুয়ারি তাঁদের ফের আদালতে হাজির করানো হবে।
আমরি-কাণ্ডের তদন্তে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। এমনকী বণিকসভা ফিকি-ও এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর লোকেদের গ্রেফতার করায় দেশের শিল্পপতিদের মধ্যে ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেছিল। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত না-থাকা সত্ত্বেও কেন আমরি-কর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছে বণিকসভাটি।
আবার গত পাঁচ জানুয়ারি আমরি-র দুই ডিরেক্টর শ্রবণ কুমার তোদি ও রবি তোদির আইনজীবী আদালতে পরিচালন বোর্ডের ১৫ জন সদস্যের তালিকা জমা দিয়ে বলেন, “ওই তালিকায় হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মণি ছেত্রী, রাজ্য সরকারের তিন প্রতিনিধি এবং নামী চিকিৎসকের নাম রয়েছে। পুলিশ শুধু সাত জনকে ধরেছে।” আমরি-র অন্য তিন ডিরেক্টরের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি এবং অন্য দুই বোর্ড সদস্যকে এই মামলায় কেন জড়ানো হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে লালবাজার সূত্রের খবর, তদন্তের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাকিদেরও গ্রেফতার করা হতে পারে।
আমরি-র পরিচালন বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা। মাস কয়েক আগে সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নেওয়ার পরে নতুন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকে ওই পদ দেওয়া হয়নি। চেয়ারম্যান পদটি তাই ফাঁকা রয়েছে। রাজ্য সরকারের দুই আইএএস প্রতিনিধির মধ্যে এক জন অসীম দাস অবসর নিয়েছেন। তাঁর জায়গায় নতুন লোক নিয়োগ হয়নি। অন্য এক আইএএস প্রতিনিধি সুকুমার ভট্টাচার্য ৩১ জানুয়ারি অবসর নেবেন। পরিচালন বোর্ডে এ ছাড়া রয়েছেন কলকাতার চিকিৎসক প্রণব দাশগুপ্ত এবং মণি ছেত্রী। মণিবাবু অসুস্থ। তাঁকে অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
পৃথাদেবী ও সাজিদ হোসেনকে গ্রেফতারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লালবাজারের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই দুই কর্তাকে গ্রেফতার করার জন্য মৃতদের আত্মীয়দের পক্ষ থেকে চাপ বাড়ছিল। পৃথা হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজকর্মের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর সাজিদ হোসেন সেই রাতে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন রোগীর আত্মীয়রা। গত রবিবারই নন্দন চত্বরে জমায়েত করে তাঁরা নিজেদের দাবি নিয়ে সরব হয়েছিলেন।
আমরি-র ‘বিষ-ধোঁয়া’য় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত প্রকৃতা পালের বাবা ধনঞ্জয় পাল এ দিন বলেন, “মেয়েকে বাঁচাতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম। সাজিদ আমাকে উপরে উঠতে দেয়নি। পাগল বলে নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে জোর করে আটকে রেখেছিল। সর্বনাশের জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ী সাজিদই।”
আমরি-কাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন মুনমুন চক্রবর্তীও। তাঁর স্বামী শুভাশিসের প্রতিক্রিয়া, “কেবল সাজিদ নয়, ওর মতো আরও অনেকে আমাদের উপরে উঠতে বাধা দিয়েছিল। তাদেরও গ্রেফতার করুক পুলিশ।”
মৃত জহরলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্যালক অলক চক্রবর্তী বলেন, “নিরাপত্তা রক্ষীরাই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিল। আমরা বারবার বলেছি, উপরে উঠতে দিন। ওরা শুনলই না। শিকল টেনে বাইরের লোকের ঢোকা বন্ধ করে দিল। এই অপরাধের কি কোনও শাস্তি হবে না?”

আমরি-কর্তারা কে কোথায়
জেলে
• শ্রবণকুমার তোদি
• রাধেশ্যাম গোয়েনকা
• রবি তোদি
• প্রশান্ত গোয়েনকা
• মণীশ গোয়েনকা
• দয়ানন্দ অগ্রবাল
এসএসকেএম হাসপাতালে
রাধেশ্যাম অগ্রবাল
ফেরার
আদিত্যবর্ধন অগ্রবাল
• রাহুল তোদি
• প্রীতি সুরেখা
বোর্ড সদস্য (অভিযুক্ত নন)
রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা (চেয়ারম্যান)
• (সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নেওয়ার পরে পদ খালি)
• সুকুমার ভট্টাচার্য (আইএএস, রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি)
• রাজ্য সরকারের অন্য আইএএস প্রতিনিধি (এখন কেউ নেই)
• মণি ছেত্রী (ম্যানেজিং ডিরেক্টর, চিকিৎসক)
• প্রণব দাশগুপ্ত (চিকিৎসক)
অন্য যে সব কর্তা ধৃত
সত্যব্রত উপাধ্যায় (ভাইস প্রেসিডেন্ট)
• সঞ্জীব পাল (জেনারেল ম্যানেজার, মেনটেন্যান্স)
• পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় (ভাইস প্রেসিডেন্ট)
• সাজিদ হোসেন (হাসপাতালের নাইট-ইন-চার্জ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.