দলের কাছে আর্জি জানিয়েও দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ পেলেন না মানিক সান্যাল। ফের সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক হলেন ৭৮ বছর বয়সী নেতা। এই নিয়ে সাত বার ওই দায়িত্ব পেলেন তিনি। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, ডুয়ার্সের চা-বলয়ে শ্রমিকদের মধ্যে দলীয় ‘প্রভাব’ কমছে, এই ‘উপলব্ধি’ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত। চা-শ্রমিকদের দাবি আদায়ে এক সময় লাগাতার আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানিকবাবু ছাড়া এই মুহূর্তে ‘পরিস্থিতি’ সামাল দিতে সক্ষম কোনও ‘সর্বসম্মত বিকল্প’ মেলেনি।
সিপিএম সূত্রের খবর, শারীরিক সমস্যার জন্য বিধানসভা ভোটের আগেই দায়িত্ব থেকে সরতে চেয়েছিলেন মানিকবাবু। সেই সময় দল তাঁর আর্জি মেনে কাজের চাপ কিছুটা কমালেও তাঁকে একেবারে ‘অব্যাহতি’ দিতে রাজি হয়নি। তবে ভোটের পর নতুন মুখ আনার দাবি ওঠে দলের মধ্যে। সিপিএমের জেলা সম্মেলনের মঞ্চেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সেখানে ঘুরেফিরে ডুয়ার্সের চা-বলয়ে বামেদের ক্রমশ ‘দুর্বল’ হয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে। |
একদা মানিকবাবু-সহ কিছু প্রবীণ নেতার পরিশ্রমের জন্যই ডুয়ার্সের চা-বলয়ে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছিল বামেরা। কিন্তু বাম জমানাতেই ডুয়ার্সে বন্ধ হয়ে-যাওয়া চা-বাগানগুলিতে ‘অনাহার’, ‘অপুষ্টি’তে শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতে থাকে। বামেদের বিরুদ্ধে ‘শ্রমিক-বঞ্চনা’র অভিযোগকে সামনে রেখে ওই এলাকায় গত তিন বছরে প্রভাব বাড়ায় আদিবাসী বিকাশ পরিষদ। শ্রমিকদের একটা বড় অংশ পরিষদের ছাতার তলায় চলে যান।
রবিবারই ডুয়ার্সের ঢেকলাপাড়া চা-বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রকে। সিপিএমের জেলা কমিটির কিছু নেতার বক্তব্য, ওই ঘটনা থেকে ‘স্পষ্ট বার্তা’ মিলেছিল, পরিস্থিতি সামলাতে এমন কাউকে প্রয়োজন, যিনি শ্রমিক আন্দোলনটা করেছেন। শ্রমিকদের নাড়ি বোঝেন।
সিপিএম সূত্রের খবর, এই ‘পরিস্থিতি’তে চা-শ্রমিকদের ফের নিজেদের দিকে টানতে মানিকবাবুর মতো ‘অভিজ্ঞ’ নেতাদের কাজে লাগানো জরুরি বলে সম্মেলন চলাকালীনই জানিয়ে দেন রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু ডুয়ার্সের চা-বলয়ে মানিকবাবুর ‘বিকল্প’ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। তাই মানিকবাবুকেই জেলা সম্পাদক পদে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। মানিকবাবু পরে বলেন, “আমি তো দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলাম। আমাকে দল ছাড়ল না।” তাঁর বক্তব্য, “বাগানের শ্রমিকদের মহার্ঘ ভাতা আরও বাড়ানোর দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। ওই দাবি আদায় করা গেলে শ্রমিকদের আয় বাড়বে।”
মানিকবাবু জলপাইগুড়ি জেলা কমিটিতে থাকলেও ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র জেলা সম্পাদক বীরেশ শিকদার-সহ ১৪ জন বাদ পড়েছেন। দল সূত্রের দাবি, ‘শুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া’র কথা ভেবেই বীরেশবাবুকে বাদ দেওয়া হল। কারণ, বিধানসভা ভোটের আগে জলপাইগুড়িতে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। ওই ঘটনার পরেই বীরেশবাবু ‘শারীরিক কারণ’ উল্লেখ করে দায়িত্ব থেকে সরতে চান। ভোটের মুখে তাঁকে সরানো হয়নি। এ বার জেলা কমিটি থেকে বীরেশবাবুকে সরিয়ে ‘শুদ্ধকরণে’র বার্তা দেওয়া হল। বীরেশবাবু অবশ্য বলেছেন, “অন্য কারণ নেই। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না বলে দলের কাছে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলাম। জেলা সম্মেলনেও যাইনি। দল অব্যাহতি দেওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ।” প্রসঙ্গত, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্কে তখন জড়িয়ে গিয়েছিল মানিকবাবুর নামও।
জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির সদস্যসংখ্যাও কমানো হয়েছে। গত বার সদস্য ছিলেন ৬৫ জন। এ বারের জেলা কমিটি ৬০ জনের। কমিটিতে মালবাজারের বিধায়ক বুলু চিক বরাইক, ধূপগুড়ির বিধায়ক মমতা রায়ের মতো নতুনদের জায়গা দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বয়সজনিত অসুস্থতার কারণে যাঁরা ‘অব্যাহতি’ চেয়েছেন, তাঁদের কমিটিতে রাখা হয়নি বলে সিপিএম সূত্রের বক্তব্য। |