রাজ্যে কৃষক-মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ভিন্নমত’ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
মুখ্যমন্ত্রী যখন বারবার বলছেন, আত্মঘাতীরা সকলেই কৃষক নন (তাঁর বক্তব্য, মৃতদের মধ্যে মাত্র এক জনই কৃষক), তখন রাজ্যপাল বলেছেন, “দুভার্গ্যজনক হলেও ঘটনাটা ঘটছে। ওই কৃষকদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত ছিলেন বলে আমার কাছে খবর। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দু’পক্ষকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। পদক্ষেপ করতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে উপায় বার করতেই হবে। যাতে এই ঘটনা না ঘটে, তা দেখতে হবে।”
সোমবার সকালে নেতাজি ভবনে এক অনুষ্ঠান-শেষে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে নারায়ণনের ওই মন্তব্যের কথা জেনে ‘ক্ষুব্ধ’ মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে অনুযোগ করেন, রাজ্যপাল সব বিষয়েই সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করছেন! বস্তুত, মমতা-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “যে ভাবে রাজ্যপাল বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন, তাতে মনে হচ্ছে, উনি সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছেন!” তৃণমূল সূত্রের খবর, রাজ্যপালের নিয়মিত প্রকাশ্যে মন্তব্যের বিষয় কেন্দ্রীয় স্তরেও জানানো হচ্ছে। প্রশাসনের একাংশেরও মত, রাজ্যপাল বিভিন্ন বিষয়ে ‘অযাচিত’ ভাবে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলছেন। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে যা তাঁর কাছে ‘প্রত্যাশিত’ নয়। তিনি যা বলার, সরকারকে একান্তে বলবেন। প্রকাশ্যে নয়। এটাই দস্তুর। কিন্তু রাজ্যপাল সেই ‘রীতি’ মানছেন না।
রাতে কাঁকুড়গাছিতে সুভাষমেলা উদ্বোধনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন (স্পষ্টতই তাঁর ইঙ্গিত রাজ্যপালের মন্তব্যের প্রতি), “আমাদের কাছে যে রিপোর্ট রয়েছে, তাতে এক কৃষক মারা গিয়েছেন। বাকিরা কৃষক নন। কিন্তু কেউ আত্মহত্যা করলেই তাঁকে কৃষক বলা হচ্ছে। হয়তো অন্য কারণে তাঁর চার-পাঁচ বছর ধরে দেনা হয়েছিল। তার থেকেই অবসাদ হয়েছে হয়তো! কারও কোনও দুঃখ হলে জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলুন। কেউ আত্মহত্যা করলেই কৃষক বলে চালানোটা কৌশল করে দুষ্টুমি! যদি সত্যি কোনও চাষি মারা যান, আমি তাঁর দায়িত্ব নেব!”
বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ‘অন্যায্য’ সমালোচনা হচ্ছে জানিয়ে মমতা প্রকাশ্যেই জনতাকে বলেন, “আমি কারও দয়ায় রাজনীতি করি না। জীবন দিয়ে কাজগুলো করছি। অর্থাভাবের মধ্যেও কাজ করছি। যা করব বলেছিলাম, তার দশ গুণ কাজ করে দিয়েছি। ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলেও মন্ত্রীরা সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। আগে তো কেউ যেতই না!” এর পরেই তাঁর ঘোষণা, “যে দিন আপনারা ভুল বুঝবেন, আমি সরে যাব!”
মমতার আরও বক্তব্য, “এই কুৎসা করে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে হটিয়ে ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। কিন্তু সেটা ছিল কংগ্রেসের সরকার। এটা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। ওরা যদি বুনো ওল হয়, আমরা বাঘা তেঁতুল। পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এটা মানতে হবে।”
প্রসঙ্গত, কৃষক-মৃত্যু নিয়ে সরকারের সমালোচনায় নেমেছে জোটশরিক কংগ্রেসও। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্য নিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। কৃষক কাকে বলে, সেটাই এখন মা-মাটি-মানুষের সরকারকে শেখাতে হচ্ছে। কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে শুধু বিরোধীরা নয়, তাঁর সরকারের নেতা-মন্ত্রীরাও মুখ খুলেছেন। এমনকী, রাজ্যপালও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী সত্যানুসন্ধানের চেষ্টা করছেন না!”
সিদ্ধার্থবাবুর শাসনকাল নিয়ে মমতার বক্তব্যের বিষয়ে সূর্যবাবুর পাল্টা মন্তব্য, “এগুলো অপপ্রচার নয়। ইতিহাস। উনি অস্বীকার করতে চাইলে করবেন।” প্রত্যাশিত ভাবেই, রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী ‘মতানৈক্যে’ খুশি সিপিএম। যারা ক্ষমতায় থাকাকালীন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী নন্দীগ্রাম-সহ বিভিন্ন ঘটনায় মুখ খোলায় তাঁকে ‘তৃণমূলের এজেন্ট’ বলেছিল!
কৃষক-মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপালের ‘মতদ্বৈতে’ রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মহাকরণ-রাজভবনে ‘দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে’র আবহ দেখছে। কিন্তু ঘটনাচক্রে, নেতাজি ভবনের অনুষ্ঠানেই সরকারি হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাজ্যপালকে প্রশ্ন করায় তিনি রাজ্য সরকারের ‘পাশে’ই দাঁড়িয়েছেন। শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে কি রাজ্য সরকারের তরফে ‘ছোট’ করে দেখানো হচ্ছে? জবাবে রাজ্যপাল বলেন, “না। আমি তেমন মনে করি না। সকলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। বিষয়টি ঘটছে। নির্দিষ্ট করে কাউকে এ ব্যাপারে দায়বদ্ধ করতে চাই না। এমন ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা রাতারাতি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি না।”
প্রসঙ্গত, এর আগে রাজ্যপাল শিক্ষায়তনে শিক্ষক-নিগ্রহ নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনা করলেও এবং সরাসরি শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি লিখে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানালেও যৌথবাহিনীর অভিযানে মাওবাদী নেতা কিষেণজির মৃত্যু, ভবানীপুর-কাণ্ড সহ বিভিন্ন বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য প্রশাসনের ‘পাশে’ও দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে প্রশাসনিক মহল এ দিনের ‘চাপানউতোর’কে এখনই মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপাল ‘সংঘাত’ বলতে নারাজ।
প্রশাসনিক মহলের আরও বক্তব্য রাজ্যপালের ওই মন্তব্য ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ নয়। তিনি সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এবং কৃষক-মৃত্যুর ঘটনায় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় তরফই ‘উদ্বিগ্ন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের আরও বক্তব্য, রাজ্যপাল মন্তব্য করার পর বিষয়টি সেখানে উপস্থিত কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশের কোর্টে ঠেলে দিয়ে বলেছিলেন, “এখানে জয়রাম রমেশ রয়েছেন। গ্রামীণ রোজগারের বিষয়টি উনি দেখেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন। উনি বলতে পারবেন।” রমেশ যার জবাবে আবার পরে বলেন, “বিষয়টি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক জানে। বিষয়টি ওদেরই দেখার কথা। আমার নয়। রাজ্যপাল কেন আমার কথা বললেন, জানি না।” তবে কৃষক-মৃত্যু নিয়ে রাজ্যপালের এ দিনের মন্তব্যে সরকার যে খানিকটা ‘অস্বস্তি’তে, তা প্রশাসনের একাংশ মেনে নিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক না রাজ্যপাল তা নিয়ে সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ দিন কোনও কথা বলা হয়নি। কৃষক-মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মহাকরণে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ শুধু বলেন, “বিষয়টি কৃষিসচিব দেখছেন। জেলাগুলি থেকে এ বিষয়ে রিপোর্ট আসছে। কৃষিসচিব সেগুলি একত্রিত করছেন।”
প্রত্যাশিত ভাবেই রাজ্যপালের মন্তব্যে ‘খুশি’ প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। রাজ্যপালের বক্তব্যকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি মদন ঘোষ বলেন, “রাজ্যপাল তো সরকারি সূত্রেই খবর পেয়েছেন ঋণের দায়ে একের পর এক কৃষক আত্মহত্যা করছেন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী-খাদ্যমন্ত্রী-শিল্পমন্ত্রীতিন জনই বলছেন, তেমন কোনও খবর সরকারের কাছে নেই। অর্থাৎ রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এক কথা এবং প্রশাসনিক প্রধান অন্য কথা বলছেন। বক্তব্যের এই পার্থক্যই দেখিয়ে দিচ্ছে, কী ভাবে সরকার চলছে!”
মদনবাবু আরও বলেন, “রাজ্যপাল কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি জানানোয় কৃষক সভার পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ। তিনি বুঝতে পেরেছেন, কৃষকদের আত্মহত্যা বন্ধ করতে সরকারকে সহানুভূতিশীল ও সক্রিয় হতে হবে। আশা করি, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এ কথা বলার পরে রাজ্য সরকার সক্রিয় হবে এবং কৃষকদের আত্মহত্যা বন্ধে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।” |