শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সৌজন্যে’ই নেতাজি-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের সরাসরি সংঘাত এড়ানো গেল। রেড রোডে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে প্রথম মালা দেওয়ার জন্য প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষকে এগিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। অশোকবাবুর সঙ্গেই মাল্যদান করলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু-সহ অন্য বাম নেতারা। তাঁদের পরে আরও কিছু মানুষ এবং সব শেষে মুখ্যমন্ত্রী।
বস্তুত, নেতাজির ১১৬তম জন্মদিন পালনে এ বার দু’টি ‘পরিবর্তন’ ঘটল। প্রথা ভেঙে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মালা দিলেন সকলের শেষে। দ্বিতীয়ত, আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে থাকলেও জন্মদিন পালনের সরকারি অনুষ্ঠানে মাল্যদানের পর ভাষণ দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে তাঁদের এগিয়ে দেওয়ার ‘সৌজন্যে’ বাম নেতারা যে ‘খুশি’, বিমানবাবু তা জানাতে ভোলেননি। তবে সেই ‘সৌজন্যে’র আবহেও নেতাজি-স্মরণ ঘিরে ‘তিক্ততা’ মোছেনি। মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বক্তা হওয়ার প্রস্তাব না-মানায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অশোকবাবু। রাজ্য সরকারের মনোভাবের ‘প্রতিবাদে’ সোমবার রেড রোডে কোনও অনুষ্ঠান করেনি ফব-প্রভাবিত কেন্দ্রীয় নেতাজি জয়ন্তী কমিটি। |
রেড রোডের অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই এলগিন রোডে নেতাজি ভবনে গিয়ে অবশ্য নাম না-করে সিপিএম-কে নেতাজি-প্রশ্নে এক হাত নেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সম্মান জানানোর কোনও সময় হয় না। যারা এক সময়ে নেতাজিকে তোজোর দালাল বলেছে, তারা আজ সম্মান জানাচ্ছে! আগে সংশোধন হওয়ার প্রয়োজন আছে। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে!”
ওই বক্তৃতার শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “আমরা এই দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করতে চাই। যিনি দেশনেতা, তাঁর জন্মদিন সর্বক্ষণ, প্রতি বছর, প্রতি মাসে, যে কোনও মুহূর্তে স্মরণ করা যায়! আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছিলাম ২৩ জানুয়ারি জাতীয় ছুটি ঘোষণা করার জন্য।” প্রশাসনিক মহলের মতে, এর মাধ্যমে মহাকরণে দু’দিন আগেই নেতাজির জন্মদিন পালন করা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জবাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
নেতাজি জয়ন্তী পালন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে ‘সংঘাতে’র বাতাবরণকে ‘গায়ে-পড়ে ঝগড়া’ বলেই অভিহিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সন্ধ্যায় কাঁকুড়গাছিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নেতাজির জন্মদিনে ওরা প্রথমে মালা দেবে বলল। তা দিক না! সরকার তো এটাই চায়। প্রথমে মানুষ দেবে। আমার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে কোনও লাভ নেই!” তাঁর আরও মন্তব্য, “যখন প্রথমে মালা দিত, তখন দল আর সরকার এক ছিল, সেটা কি ভুলে গিয়েছে? এখন তো সরকার বদলে গিয়েছে!”
এ দিন রেড রোডের অনুষ্ঠানে ‘নাটকীয়তা’ ছিল। মুখ্যমন্ত্রী পৌনে ১২টা নাগাদ পৌঁছে চারপাশ ঘুরে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই চত্বরটিকে আলো দিয়ে সাজিয়ে রাখার কথাও বলেন। নেতাজি মূর্তিতে মাল্যদান শুরুর আগেই বিমানবাবু, অশোকবাবুরা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন। মুখ্যমন্ত্রী খবর পেয়ে তৃণমূলের ছাত্র-নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকে বলেন, তাঁদের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসার জন্য। পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারকে নির্দেশ দেন, অশোকবাবুদের ‘অভ্যর্থনা’ করতে। মুখ্যসচিব সমর ঘোষ-সহ সরকারি আধিকারিকদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, অশোকবাবুরাই আগে মালা দেবেন। সেই মতো সওয়া ১২টায় সাইরেন বাজার পর অশোকবাবু, বিমানবাবু, ক্ষিতি গোস্বামী, মঞ্জুকুমার মজুমদার, মনোজ ভট্টাচার্য, প্রতিম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বাম নেতা মাল্যদান করেন। মুখ্যমন্ত্রী তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এর পর কিছু সাধারণ মানুষ। তার পরে মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে মালা দেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের মন্ত্রী অমিত মিত্র এবং নেতাজির পরিবারের সদস্য সুগত বসু। মাল্যদানের পর বাম নেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি সৌজন্য বিনিময় হয়। অশোকবাবুর হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, প্রবীণ নেতা অনুষ্ঠানে আসায় তাঁরা খুশি। অশোকবাবু পাল্টা ধন্যবাদ জানিয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, কাজটা ‘ঠিক’ হল না। |
রাজ্যের প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীরই প্রথম মালা দেওয়া উচিত ছিল। কলকাতা পুলিশের কুচকাওয়াজের আগে অনুষ্ঠানস্থল ছাড়েন বাম নেতারা। তার আগে বিমানবাবু বলেন, “আমরা এসে দেখলাম, কর্মসূচি পরিবর্তন হয়ে গেল! আমরা দাঁড়িয়েছিলাম মালা দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখলাম, মুখ্যমন্ত্রী মালা দিলেন না। আমরাই প্রথম দিলাম। হয়তো বিতর্কটা এমন জায়গায় গিয়েছিল, অনুষ্ঠান বানচাল হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয়েছিল! সেই জায়গায় আমরা খুশি।” প্রথা ভেঙে আগে অশোকবাবুকে মালা দিতে বলার ঘটনা প্রসঙ্গে বিমানবাবুর মন্তব্য, “খুবই ভাল। তবে সরকার গোড়া থেকে বিষয়টা দেখলে এই অবস্থা তৈরি হত না।” আর রেড রোড ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “নেতাজি সকলের। সুন্দর অনুষ্ঠান হয়েছে। আমরা খুশি।”
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘সংঘাতে’র বাতাবরণ প্রথম তৈরি হয়েছিল অশোকবাবুর সঙ্গেই। নেতাজি-প্রশ্নে গত কয়েক দিনে তাঁর দু’টি চিঠির উত্তর দেননি মুখ্যমন্ত্রী। নেতাজির জন্মদিবসের অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরে সল্টলেকে ‘নেতাজি সুভাষ ফাউন্ডেশনে’র দ্বারোদঘাটন করতে গিয়ে অশোকবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমরা যা করার, শান্ত ভাবেই করতে চেয়েছিলাম। যা হল, তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। এতে রাজনৈতিক নেতাদের মর্যাদা কি খুব বাড়ল? এটা রাজ্য সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেই মনে করি।” ঘনিষ্ঠ মহলে এই প্রবীণ বাম নেতার অভিমত, রেড রোডের অনুষ্ঠানটিই সরকারি কর্মসূচি। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর প্রথমে মালা না-দেওয়া এবং বক্তৃতা না-করা ‘রীতিসম্মত’ নয়। ‘সৌজন্য’ দেখাতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিঠির উত্তর দিয়ে আলোচনা করেই অনুষ্ঠান করতে পারতেন। এত ‘বিভ্রান্তি’র কোনও প্রয়োজন ছিল না। সিপিএম-কে যে ভাবে কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তা-ও ‘বাঞ্ছনীয়’ নয় বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন অশোকবাবু। তাঁর মতে, সেই ১৯৭০ সালেই নেতাজির নামে প্রদর্শনীতে এসে জ্যোতি বসু কমিউনিস্টদের পুরনো মূল্যায়নের ভুল স্বীকার করেছিলেন। এত দিন পর সেই পুরনো প্রসঙ্গ টেনে বিতর্ক ‘কাঙ্ক্ষিত’ নয়।
ময়দানের অনুষ্ঠানে ছিলেন নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বারকানাথ বসু। এই প্রথম ওই অনুষ্ঠানে মালা দিতে পারার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ধন্যবাদ’ জানান তিনি। নেতাজির আরও এক ভ্রাতুষ্পুত্র, ফ ব-র প্রাক্তন সাংসদ সুব্রত বসুকেও দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকেই বলেন, প্রথম মালা দিতে। সুব্রতবাবু অবশ্য সবিনয়ে বলেন, তা হয় না। তখন অশোকবাবুদের এগিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় ‘সুভাষ মেলা’য় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিমান বসুরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কত কুৎসা করেন! আজ অন্তত কুর্নিশ করুন তাঁকে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি অশোক ঘোষকে আগে মালা দিতে দিয়ে সৌজন্যের এমন নজির গড়লেন।” |