হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা মকবুল ফিদা হুসেনকে স্বদেশে ফিরতে দেয়নি। মুসলিম মৌলবাদীরা
রুশদিকে এ দেশে পা রাখতে দিল না। দুর্ভাগ্য গণতান্ত্রিক ভারতের। লিখছেন
গৌতম রায় |
রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে অনুষ্ঠেয় সাহিত্য উৎসবে সলমন রুশদির যোগদান বন্ধ করতে দেওবন্দের মুসলিম শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে। বিধানসভা নির্বাচনের জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্রচারে নামা উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেন এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মুসলিম ভোটারদের সহানুভূতি কুড়োনোর সুযোগ। ‘স্যাটানিক ভাসের্স’-এর (চব্বিশ বছর আগে প্রকাশিত) লেখক সলমন রুশদিকে ভারতে আসতে দেওয়া মানে মুসলিমদের সেই ক্ষত খুঁচিয়ে তোলা। অতএব রুশদির ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হোক। দারুল উলুমের বক্তব্য লুফে নিয়ে সব দলই রুশদির মুণ্ডু চাইতে ময়দানে নেমে পড়ে। বিজেপি-ও, পটচিত্রে হিন্দু দেবদেবীর ‘অবমাননা’র দায়ে বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনকে কয়েক বছর আগে দেশছাড়া করেছিল যে-দল। হুসেন আর তাঁর স্বদেশে ফিরতে পারেননি, প্রবাসেই তাঁর জীবতারা খসে যায়।
রাজনীতিকদের তাগিদটা বোঝা কঠিন নয়। উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ভোটার ১৯ শতাংশ। অ-মুসলিম ভোট যে গো-বলয়ে জাতপাতের ভিত্তিতে ভীষণ ভাবে খণ্ডিত, তুখড় ‘সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ দিয়ে যেখানে বিভিন্ন জাত, উপ-জাতের কৌশলগত ভোটদানের (tactical voting) উপর ভরসা করে ঘুঁটি সাজাতে হয়, সেখানে যদি কোনও দল মুসলিমদের পুরো ১৯ শতাংশ ভোট কুক্ষিগত করে ফেলতে পারে, তবে লখনউয়ের মসনদ তো এমনিই তার হাতের মুঠোয়। অতএব মুসলিম আবেগ উস্কে দিয়ে সংখ্যালঘু ভোট টানার প্রতিযোগিতায় সবাই কোমর বেঁধে নেমে পড়ে।
এই রণকৌশলের মধ্যে দুটো বড় গলদ থেকে যাচ্ছে। এক, মুসলিমরা সম্প্রদায়গত ভাবে কোনও বিশেষ দল বা প্রার্থীকে ভোট দেন, এই সরল সমীকরণটি ভুল। এই অনুমান বা ধারণার পক্ষে কোনও প্রমাণ নেই, কোনও প্রাক্ বা উত্তর-নির্বাচনী সমীক্ষায় এমন তথ্য উন্মোচিত হয়নি, ভোট-পণ্ডিত বা বিশ্লেষকরাও এ যাবৎ কোনও অকাট্য প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। দুই, সলমন রুশদি কিংবা তাঁর স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে ভারতীয় মুসলিম মানস মাথা ঘামায়, এমন কোনও প্রমাণও নেই। |
‘চাই না’। সলমন রুশদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। জয়পুর, ২০ জানুয়ারি ২০১২। ছবি: এ এফ পি |
বরং উল্টো দিকের প্রমাণ অনেক আছে। চেনা-জানা যে কোনও মুসলিম প্রতিবেশীকে প্রশ্ন করে দেখুন সলমন রুশদি কে? উত্তর না-পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাঁর উপন্যাস বা লেখালিখি পড়ে দেখার তো প্রশ্নই নেই। দ্বিতীয়ত, রুশদি এই প্রথম ভারতে আসছিলেন, এমনও নয়। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে বিতর্কের পর ও প্রয়াত রাজীব গাঁধীর উদ্যোগে ওই বই ভারতে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও একাধিক বার রুশদি ভারতে এসেছেন, মুম্বইয়ে থেকেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। এমনকী এই জয়পুরেই ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবেও অংশগ্রহণ করেছেন। তখন কিন্তু দারুল উলুমের আধিকারিকদের কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। কোনও মুসলিম সংগঠনকেও পথে নামতে দেখা যায়নি। বস্তুত, সাধারণ মুসলমানের রুশদিকে নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই, আর ধর্মের প্রশ্নে মনোবেদনা হলেও তা নিয়ে রাস্তায় নামার কথা তাঁরা ভাবেন না। তাই বলে অবশ্য তাঁদের ভাবানোর কিংবা উস্কানোর লোকের অভাব নেই। কারা সেই প্ররোচক? রাজনীতিক এবং সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা।
রাজনীতিকদের সংখ্যালঘু তোষণ করতে হয় জনপ্রিয়তা রক্ষা বা বৃদ্ধির স্বার্থে। শাসক ও বিরোধী, উভয় দলের নেতারাই তাই সংখ্যালঘুর অনগ্রসরতা দূর করার পরিকল্পনা রচনায় ব্যতিব্যস্ত। কার্যক্ষেত্রে বিশেষ কিছু হয় না। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিংবা প্রতিশ্রুতির রূপায়ণ স্থগিত থাকে, কেবল কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ ও প্রসাধনী প্রলেপ দিয়ে সংখ্যালঘুর ক্ষোভকে সাময়িক ভাবে প্রশমিত করা হয়। যেমন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘মাদ্রাসা’ না হোক, অন্তত ‘মুসলিম’ কথাটা জুড়ে দেওয়া। যেমন ইন্দিরা ভবনকে ‘নজরুল অ্যাকাডেমি’ বানিয়ে দেওয়া। যেমন রমজানের উপবাস ভঙ্গ করার ভোজে বিশিষ্ট মুসলিমদের দলের তরফে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো। রাজনীতিকরা নিশ্চয় ভাবেন যে এতেই আম মুসলিম জনতার কাছে অভিপ্রেত বার্তাটি চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের এই ছলনা মুসলমানরা প্রায়ই ধরে ফেলেন। তাঁরা নিশ্চয় এটাও ভেবে মজা পান যে, গত ছয় দশক ধরে তাঁদের ‘উন্নয়ন’-এর জন্য রাজনীতিকরা যত আশ্বাস দিয়েছেন, তা যদি আন্তরিক হত, যত প্রতিশ্রুতি, সব যদি রূপায়িত হত, তা হলে ভারতীয় মুসলমানরা এত দিনে আর অনুন্নত থাকতেন না, তাঁদের ওবিসি সংরক্ষণের কোটাতেও ভাগ বসাতে হত না।
ধর্মীয় নেতাদের সমস্যাটা একটু আলাদা। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তাঁদের নিজ সম্প্রদায়কে নিরন্তর বিপন্নতার মধ্যে, প্ররোচনা ও উস্কানির মধ্যে ফেলে রাখতে হয়। মীনাক্ষীপুরমে কিছু দলিত হিন্দু ধর্ম ছেড়ে (যেন এ-ধর্ম কোনও দিন তাদের ‘ধারণ’ করে রেখেছিল) দিলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধুসন্তরা ‘হিন্দু বিপন্ন, হিন্দুর সমাজ ও ধর্ম বিপন্ন’ আওয়াজ তুলে দেশ জুড়ে হিন্দু-একাত্মতা-যজ্ঞ শুরু করেন, যার মঞ্চ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীও এই বিপন্নতার প্রতিধ্বনি তোলেন। রুশদির উপন্যাস না পড়েই তেমনি স্রেফ জনরবের ভিত্তিতে মোল্লা-মৌলবি-উলেমা-ইমামরা ইসলামের বিপন্নতার ধুয়ো তুলেছিলেন। ডেনমার্কের সংবাদপত্রে মহম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ হওয়ার পরও বিশ্বের দেশে দেশে মৌলবি-ইমামরা একই রকম রণধ্বনি তুলে পথের হিংসায় নামতে নিজ সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করেন। যেন রাস্তায় নেমে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, লুঠপাট চালালেই সেই বিপন্নতা দূর হবে। এ ভাবেই ইসলাম বিপন্ন বলে প্রচার করে কলকাতার কিছু স্বার্থান্বেষী তসলিমা নাসরিনকে রাজ্যছাড়া করতে মহানগরীকে রণক্ষেত্র করে তোলেন।
এই ধর্মব্যবসায়ীদের কখনও কেউ কোনও সামাজিক কল্যাণের কাজে উৎসাহ দিতে দেখেছেন? মুসলমানের শিক্ষার প্রসারে, মুসলিম শিশুদের পোলিয়ো প্রতিষেধক খাওয়ানোর অভিযানে, মুসলিম মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ দূর করার আন্দোলনে কখনও কোনও মৌলবি-ইমামকে দেখা যায় না কেন? কারণ এ সব কাজে সম্প্রদায়ের মন জয় করা গেলেও তাকে সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় না। আর সন্ত্রস্ত হয়ে না থাকলে তাঁদের জীবনে মোল্লা মৌলবিরা তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন, তাঁদের কেউ পুঁছবে না। অতএব ভয় দেখাও যে তোমার ইমান, তোমার ধর্মাচরণের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ভয় দেখিয়ে লোক খ্যাপাও, জুম্মা বারের নমাজি সমাবেশ থেকে রণহুঙ্কার তোলো, তাতিয়ে দাও। যা নিয়ে মুসলমান সমাজের কোনও মাথাব্যথা নেই, সেই অবান্তর, অকিঞ্চিৎকর, প্রান্তিক বিষয়কেও সম্প্রদায়ের সামনে তুলে আনো, তাকে জীবন-মরণের, ইসলামের সবুজ নিশান তুলে-ধরা কিংবা ধুলোয় লুটোতে দেওয়ার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন করে তোলো। তবেই মানুষ তোমার কাছে পথনির্দেশের জন্য ভিড় করবে। আর যদি স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ছদ্ম সংখ্যালঘু-প্রীতিকে এর সঙ্গে জুড়ে নিতে পারো, তা হলে তো কায়ামতই কায়ামত!
পুনশ্চ: দারুল উলুম এবং রাজনীতিকদের আর্জি মেনে রাজস্থান সরকার রুশদিকে জয়পুরে না-আসতে ‘বিনীত অনুরোধ’ জানিয়েছে। সম্মেলনের সূচি থেকেও রুশদির অনুষ্ঠান বাদ পড়েছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা মকবুল ফিদা হুসেনকে স্বদেশে ফিরতে দেয়নি। মুসলিম মৌলবাদীরা রুশদিকে এ দেশে পা রাখতে দিল না। |