হাতিবাগান অঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহগুলো একে একে বিলুপ্ত হল। এখন সেগুলো বিয়েবাড়ি, শারদ-সেল ইত্যাদির কারণে ব্যবহৃত হয়। জানা নেই, আবার কোনও দিন বৃহস্পতিবার বা শনি-রবিবারের সন্ধে, দুপুরগুলো শুধু নাটক দেখতে আসা জনগণের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠবে কি না। ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলগুলো নিয়ে বিভাস চক্রবর্তী বা কৌশিক সেন-রা কতটা ভাবিত জানতে ইচ্ছা করে। সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন। কান্না-হাসির দোল-দোলানো নাটকগুলো দেখতে যাঁরা আসতেন, তাঁরা কিন্তু একটা ‘শ্রেণিভুক্ত’। তাঁদের কাছে ‘রুদ্ধসংগীত’, ‘শ্রীশম্ভু মিত্র’ বা ‘নটীর পূজা’ আদৃত হবে না। তাঁরা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘সম্রাট ও সুন্দরী’ বা ‘কনে বিভ্রাট’ দেখে মজে যেতেন। আর এক শ্রেণির দর্শক ছিলেন, যাঁরা অভিনয় দেখতে ছুটে যেতেন ‘না’, ‘শ্যামলী’ বা স্বরলিপি’-তে। নাক উঁচু দর্শকরাও ফাঁকতালে ঢুকে পড়তেন। আর এই সব রঙ্গমঞ্চে যখন ‘শেফালি’ এলেন, তখন, শুধু ওই নাচের দৃশ্য দেখতেই ব্যাপক ভিড় হত। |
হাতিবাগান-এর নাট্যমঞ্চে দর্শকদের ভিড়। |
কলকাতায় বেড়াতে আসা প্রবাসী বাঙালির কাছে হাতিবাগানের নাটক ‘অবশ্য দর্শনীয়’ ছিল। কী কারণে বাংলা সাহিত্য-নির্ভর কাহিনিতে ভরসা রেখে আবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘নীলকণ্ঠ’ বা ‘রাজকুমার’-এর মতো নাটক নামাতে ভরসা পান না, তা তাঁরা বা তিনিই জানেন। প্রযোজক পাওয়া যাবে না? বয়সজনিত কারণ?
এখন অন্য রকম থিয়েটারে সাফল্যের সঙ্গে দুশো তিনশো শো অতিক্রান্ত হয়ে যায়। বুদ্ধিমান, রুচিশীল দর্শক আকাদেমি-সদন বা গিরিশে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে নাটক দেখেন। নাট্যোৎসব এখন মার খায় না। শুধু ভাল নাটক দেখতে বনগাঁ, বারাসত থেকে দর্শক ছুটে যান। তাঁরা সরকারি অনুদান বা সমালোচনার ধার ধারেন না। প্রতিবাদ করছি না। শুধু মজা লাগে যখন দেখি, নিয়মিত নাটক দেখিয়ে দর্শকদের তুলনায় হলে কোনও ফিল্মি তারকার পদার্পণ ঘটলে একটা নীরব শোরগোল পড়ে যায়। নাট্যদলগুলো তখন বোধহয় এক ভিন্ন শ্লাঘা বোধ করেন। এহ বাহ্য। সাধারণ দর্শকরা তো আর ‘অসাধারণ’ নন।
সম্প্রতি টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে আসছেন। একটা বোধহয় সূক্ষ্ম চাল কাজ করে নাটকের পরিচালক-প্রযোজকদের ভেতর। একেবারে সাধারণ দর্শকও ছুটে আসবেন স্টার দেখতে। এটাই কি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার একটা ব্যতিক্রমী চাবিকাঠি?
বাংলা নাটকের নিয়মিত দর্শক হিসাবে মনে হয়, টিভি সিরিয়ালে বা সিনেমায় মুখ না-দেখানো অভিনেতাদের দিয়েও কিন্তু নাটক ‘হাউসফুল’ হয় এবং হয়েছেও। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতিক্রম। নাটক-সিনেমায় তিনি সমান দুরন্ত। ‘রাজা লিয়র’ তা প্রমাণ করে। কিন্তু সিনেমায় বাজার নেই বলে নাটকে চলে আসা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে প্রশ্ন জাগেই। অন্য থিয়েটারের দর্শক নাটকে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাকে দেখতে যান না। তাঁরা যান অন্য টানে।
সারা রাত নাটক সম্পর্কে বলি, ওটাও বছর শেষের হুল্লোড়। এটা নয় যে সব নাট্যমোদী দর্শক। একটু বেশি রাতে নাক ডাকার আওয়াজ, উসখুস এবং অবিরাম আসন ছেড়ে ওঠা-বসায় সত্যিকারের দর্শকদের বিড়ম্বনা বাড়ে। অন্য ধারার নাটকে এখন ‘কর্পোরেট অনুদান’ তো আসছেই। আর, সাম্প্রতিক ‘রেপার্টারি’ বিপ্লব এনে দিয়েছে মিনার্ভা রঙ্গমঞ্চে। সরকারি অনুদান পেলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একটা নির্দিষ্ট মাসোহারা পেতে পারেন। তবে, তাতে কি পেট ভরবে? তাই অনুদান প্রয়োজন। অনুদান ব্যতীত ভিন্ন ভাবনায় আলোচিত হয়ে নাট্যচর্চা, বোধহয় আবেগসমৃদ্ধ ভাবনা। একজন অভিনেতা-অভিনেত্রী শুধু নাটক করবেন পেটে খিদে নিয়ে? পরিচালক পাবেন তাঁর কাছ থেকে পূর্ণ অভিনয়? আর সেই কারণেই বোধহয় বিভিন্ন টি ভি সিরিয়ালে এত নতুন ছেলেমেয়ের আনাগোনা।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী। কলকাতা-১২৫ |