প্রবন্ধ ১...
যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কথা ভাবব না কেন

সাধক রামকৃষ্ণের কথা ‘যত মত তত পথ’। অর্থনীতির এই দিব্য জ্ঞান কাজে লাগতে পারে, শুনলে অর্থনীতিবিদরা তিরস্কার করবেন। তাঁরা বলবেন, অর্থশাস্ত্র হল বিজ্ঞান। সাধকের অন্তর্দৃষ্টি মানসিকতার ক্ষেত্রে চলে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চলে না। কথাটা মিথ্যে নয়, তবু একটু অন্য ভাবে ভাবলে ক্ষতি কী?
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, গবেষক, প্রশাসক এবং সাধারণ ভাবে বুদ্ধিজীবিকুল চিন্তান্বিত। চিন্তার কারণ হল, সরকার কর বসাচ্ছে না কেন বিদ্যুৎ, পরিবহণ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে? কেন মাসুল বাড়াচ্ছে না, কর বসাচ্ছে না? যদিও কর বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি ছাড়া সম্পদ বাড়ানোর আর কোনও উপায় কেউ বাতলাতে পারছেন না। আর যে একটা-দুটো উপায় শোনা যাচ্ছে, সেগুলো প্রত্যাশিত। যেমন, খুচরো পণ্য ব্যবসায়ে বিদেশি পুঁজি আসুক, তেলের দাম যত পারো বাড়াও, সামাজিক সুরক্ষা খাতে জমা টাকা বাজারে খাটাও, ইত্যাদি। এ রাস্তা জানা। বহু অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে পৌঁছে দিয়েছে এই অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা।
সমগ্র দেশের কথা বলতে পারব না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কি এই ওষুধ চলবে? কর বাড়ানোর সীমা আছে। কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নীতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রবল ভাবে গত কয়েক বছর ধরে। এই পথে যে শুধু ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায় এবং উৎপাদন মার খাবে তাই নয়, অর্থনীতির সংকোচনের ফলে বেকারি এবং দুর্বিষহ জনজীবনের দায়িত্ব কে নেবে?
অথচ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অত খারাপ নয়। টাকা এখনও এ রাজ্যে শস্তা। ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্র স্তরের উৎপাদন এখনও জোরালো। এবং পরিষেবামূলক কর্মে নিয়ত এক বিশাল জনমণ্ডলী অনুরূপ এক বিরাট, অঘোষিত, অপরিমিত, অসংগঠিত বাজারকে সমর্থন করে চলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জন-প্রশাসন, সেচ, গ্রামীণ সরবরাহ নানা দিকে নিয়োজিত এই জনমণ্ডলী। কৃষির ভিত এখনও শক্ত। এই সব বাস্তবতাকে ভিত্তি করে যে ধরনের উদ্ভাবনী নীতির প্রয়োজন, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতির এবং কর বাড়ানোর মানসিকতার কোনও মিল নেই। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের আর্থনীতিক সংকট মোচনের আলোচনার সঙ্গে জাতীয় ফিনান্স কমিশন নির্দেশিত সম্পদ ভাগাভাগি করার যে ফর্মুলা রয়েছে, তার প্রাসঙ্গিকতাও স্বল্প।
আঞ্চলিক? নয়াদিল্লির নর্থ ব্লক-এ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ২০ জুন, ২০১১।
তাই প্রশ্ন ওঠে, গোটা দেশে কি একটা অর্থনীতি, না বহু অর্থনীতি? ইউরোপে আজ এই প্রশ্ন উঠেছে গ্রিস এবং ইতালির অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে। আমি জানি, এই তুলনা টানলেই অর্থনীতিবিদরা হইহই করে উঠবেন। বলবেন, জাতীয় বাজার, জাতীয় মুদ্রা, জাতীয় আমদানি-রফতানি নীতি এই সব এক। তেমনই জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশে সমগ্র দেশ চলছে। এখানে নানা অর্থনীতির কথা কোথা থেকে আসছে? একই দাওয়াই সব জায়গায় কাজ করার কথা, এ ক্ষেত্রে করবে না কেন?
তাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন খুচরো পণ্য-ব্যবসায়ে বিদেশি প্রত্যক্ষ লগ্নির, বা তেলের দাম বৃদ্ধি, বা কয়লার দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করছেন, অর্থনীতিবিদদের মনে হচ্ছে, এ বারে অশিক্ষিত, অপরিণতদের রাজত্বে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞার মৃত্যুপ্রহর সামনে এসে পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি দেশের অন্যান্য নানা স্থান থেকে আলাদা। তাই আমাদের বুঝতে হবে, ক্ষুদ্র কৃষিকে সংহত করতে গিয়ে, শিক্ষা বিস্তার করতে গিয়ে, গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণের প্রসার করতে গিয়ে যেমন ভাল কিছু হয়েছে গত কয়েক দশকে, তেমনই সংস্কারের এই পথের সীমাবদ্ধতার এবং তজ্জনিত দৈন্যের সুযোগে অনেক খারাপও এসেছে। অসংগঠিত অর্থনীতি এই রকম এক দ্বিচারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা নিয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু, যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি, তাতে এই বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখা দরকার।
কথা হল, বৈশিষ্ট্যের বাস্তবতার ভিত্তিতে সৃজনশীল সংস্কারের পথ খুঁজতে গেলে প্রথমে বাতিল করতে হবে ‘এক অর্থনীতি এক দাওয়াই’-এর পথ। জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে: কেন এমন এক জাতীয় তহবিল থাকবে না, যেখান থেকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাজ্য বিশেষ অর্থ দাবি করতে পারে? কে, কত, কোন সময়ে, কী শর্তে এই রকম এক স্থায়িত্বকেন্দ্রিক তহবিল থেকে অর্থ নেবে সে সবই আলোচনার মাধ্যমে স্থির হতে পারে। জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের অর্থহীন আলোচনার পরিবর্তে এগুলো স্থির হতে পারে সেখানে। এক ধরনের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস-এর মতো অন্য পদক্ষেপও ভাবা যেতে পারে। যেমন সমৃদ্ধ প্রদেশ এবং যে প্রদেশের বিশেষ অর্থ প্রয়োজন, তারা বাজারে যৌথ বন্ড ছাড়তে পারে। গ্রামাঞ্চলে সম্পদ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে আঞ্চলিক ব্যাংকের পথ খোলা আছে। এক সময় এই ভাবে নানা ব্যাংক খুলে শিল্প-অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের সেই প্রসারের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের জানা। আজ রিজার্ভ ব্যাংক তার ওপর নজর রাখতে পারে, যাতে নৈরাজ্য আঞ্চলিক স্তরে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রসারকে ধ্বংস করতে না পারে। তেমনই, কেন বিশেষ উৎপাদনের এবং ব্যবসার জন্য বিশেষ তহবিল, সমবায় ব্যাংক এবং অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহমূলক পদক্ষেপ করা যাবে না? তার জন্য যেমন প্রাদেশিক এবং জেলা স্তরে শক্ত প্রশাসন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন গ্রাম ও ছোট শহরের স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের হাতে অধিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা। রাজস্ব এবং সম্পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক স্তরে কর বসানোর ক্ষমতা যার অন্তর্গত।
বহু অর্থনীতির পথে ভাবলে সৃজনশীলতার দ্বার খুলে যাবে। অর্থনীতির যুক্তরাষ্ট্রীয়করণের কথা অর্থশাস্ত্র বলে না। এমনকী প্রতিষ্ঠানমূলক অর্থশাস্ত্রও আমাদের কোনও ইঙ্গিত দেয় না, বাজার ও পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কী ভাবে কাজ করতে পারে। গণ-প্রতিষ্ঠান এবং গণ-ক্ষমতার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। বহু অর্থনীতির সহাবস্থানে নিশ্চয়ই কেন্দ্রের ভূমিকা থাকবে, কিন্তু সেটা অনেকটাই কথাবার্তামূলক অর্থনৈতিক প্রশাসনের জগতে পৌরোহিত্যের ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ সব অর্থেই দরকার। রাজনীতিতে যেমন, তেমনই অর্থনীতিতে।
একটাই জাতীয় অর্থনীতির বৈধতার ভাবনা এক বিশেষ ধরনের ক্ষমতার ভাষার ইঙ্গিত দেয়। সে বৈধতা যদি স্বীকার করতেও হয়, তার জন্যও নানা অর্থনীতি, বিভিন্ন অসংগঠিত অর্থনীতি, বিভিন্ন আঞ্চলিক অর্থনীতি, ইত্যাদির মধ্যে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় নয়, তা হল যুক্তরাষ্ট্রীয়। আঞ্চলিক স্তরে সম্পদ সংগ্রহের ওপর শুল্ক বসানোর প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক ক্ষমতা এবং তার হার নিয়েও আঞ্চলিক স্তরে ক্ষমতার কথা ভাবতে হবে। এ সব নিয়ে বিবাদ হলে মতপার্থক্য নিরসনের জন্য এক বিশেষ বেঞ্চ থাকতে পারে, এবং সেই বেঞ্চের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথাও ভাবা প্রয়োজন।
এক কথায়, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সংকট যতটা না এ রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট, তার চেয়েও বেশি এক জাতীয় আর্থিক ও আর্থনীতিক কল্পনার সংকট। এক বাজার, এক অর্থনীতি, এক কর-ব্যবস্থা, এক সম্পদসংগ্রহ ব্যবস্থার সংকট। তারই প্রতিফলন ঘটছে এই রাজ্যের আর্থজগতে। যেমন গ্রিসে আমরা ইউরোপের কেন্দ্রীভূত নীতির সংকটের প্রতিফলন দেখছি।
অর্থনীতির যুক্তরাষ্ট্রীয়করণের দিকে যদি যেতেই হয়, তা হলে সে পথে হাঁটার মূল পাথেয় কী হতে পারে? সংক্ষেপে তার উত্তর হল, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে বিভিন্ন সম্পর্কের সমষ্টি রূপে দেখা। চিনের এক মহানায়ক যার নাম দিয়েছিলেন ‘তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কাবলি’ বলে।
পশ্চিমবাংলার দিকে নজর দিলেই এই রকম বেশ কিছু সম্পর্কের দিকে নজর পড়বে। রাজধানী কলকাতা এবং কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে প্রত্যন্তের সম্পর্ক, শিল্পের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক, সংগঠিত অর্থনীতির সঙ্গে বিস্তৃত অসংগঠিত অর্থনীতির সম্পর্ক, গাঙ্গেয় বাংলার সঙ্গে খরাপ্রবণ শুষ্ক জেলাগুলির সম্পর্ক, উৎপাদনের সঙ্গে পরিবহণের সম্পর্ক, দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক, শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার সম্পর্ক, চা পাট ইত্যাদি পুরনো শিল্পগুলির উৎপাদনশীলতার সঙ্গে গোটা রাজ্যের অর্থনীতির সম্পর্ক এবং শেষত অঞ্চলভিত্তিক বৃত্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্ক। এই ন’টা সম্পর্কের সঙ্গে আমরা আরও একটা সম্পর্কের কথা ভাবতে পারি: পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির সঙ্গে দেশের অন্যান্য অর্থনীতির সম্পর্ক।
উৎপাদন এবং উৎপাদনশক্তি না বাড়লে সম্পদসংগ্রহ বাড়বে না। এবং উৎপাদনশক্তি বাড়াতে গেলে এই সম্পর্কগুলিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে, তাদের বিষয়ে অধ্যয়নে মন দিতে হবে। এই সম্পর্কগুলির মধ্যে যে অসামঞ্জস্য এবং দ্বন্দ্ব আছে, তার সমাধানে মন দিতে হবে। কেন্দ্র প্রদর্শিত পথের মোহ ছাড়তে হবে, যে মোহের আবেশে গত প্রশাসন অন্ধ ভাবে কৃষি ধ্বংসের পথে এগিয়েছিল, বাইরে থেকে পুঁজিকে স্বাগত জানাতে গিয়ে সাধারণ ব্যবহারিক বোধ-বুদ্ধি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিল, আর যা টাকা হাতে পাওয়া যেত, তা দিয়ে খালি নিত্য-নৈমিত্তিক প্রশাসন চালিয়ে গেছিল। এবং কেন্দ্র যা বলত, ধৃতরাষ্ট্রের মতো রাজ্য সরকার তা শুনে গেছিল অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে।
এ সব নিয়ে যা বলার কথা, তার অনেকটাই হয়তো সাধারণ বুদ্ধির কথা। অনেকটাই হয়তো অর্থনৈতিক প্রজ্ঞার বিরোধী। তবু সেই প্রবাদ মনে পড়ে: রান্নাঘরে কী রান্না হবে, তার নির্ধারণ হয় রান্নাঘরের বাইরে। তেমনই, অর্থনীতিতে কী ঘটবে, বা কী ঘটা উচিত, তার বেশ খানিকটাই আসে বা আসতে পারে অর্থনীতি-বহির্ভূত অন্যান্য জগতের জ্ঞানালোকে।

লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দ্য ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.