যোজনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রক তো ছিলই। এ বার ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ এল রেলেরই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি থেকে। তা-ও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এবং প্রথমে এককালীন প্রায় ২৫%।
সূত্রের খবর, রেলের আধুনিকীকরণ কমিটির চেয়ারম্যান স্যাম পিত্রোদা গত ৯ বছর রেলের ভাড়া না বাড়ার বিষয়টি মাথায় রেখে সমস্ত শ্রেণিতে এককালীন প্রায় ২৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। এর ফলে বাড়তি প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা জমা পড়বে রেলের ঘরে। ‘স্বাবলম্বী’ হতে পারবে রেল। বিভিন্ন যোজনার জন্য কথায় কথায় হাত পাততে হবে না যোজনা কমিশন বা অর্থ মন্ত্রকের কাছে।
সম্প্রতি যোজনা কমিশনের সঙ্গে একটি বৈঠকে এই মর্মে একটি ‘প্রেজেন্টেশন’ বা প্রস্তাব রেখেছেন পিত্রোদা। যদিও তিনি ও রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল দু’জনেই আজ ‘প্রেজেন্টেশন’-এর কথা অস্বীকার করে জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনও রিপোর্ট মন্ত্রকে জমা পড়েনি। পিত্রোদার বক্তব্য, রিপোর্ট এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ভাড়া ২৫% বাড়ানো আর মূল্যবৃদ্ধির ওঠাপড়ার সঙ্গে তাকে যুক্ত করার প্রসঙ্গে কী বলছেন তিনি? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে পিত্রোদার মন্তব্য, “যে রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়নি, তা নিয়ে মন্তব্য করব না।” তিনি জানান, গত তিন মাস এ নিয়ে প্রচুর খাটছে কমিটি। আর দু’সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়ে যাবে। সরকারি নিয়মের কারণে পিত্রোদারা প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে চর্চা না চাইলেও বাস্তব হল, ভাড়া বাড়ানোর জন্য রেলের উপরে চাপ আসছে সব মহল থেকেই। মন্ত্রক সূত্রের খবর, দীনেশ আধুনিকীকরণ কমিটির ধাঁচে যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটি গঠন করেছেন, সেটিও নিরাপত্তা খাতে অর্থ বাড়ানোর জন্য এক ধাপ এগিয়ে ভাড়া প্রায় ৩০% বাড়ানোর সুপারিশ করতে চলেছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, সব মহল থেকে চাপের মুখে এ বারের বাজেটে ভাড়া বাড়ানো নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী? তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, দীনেশ চান ভাড়া বাড়াতে। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেননি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাত্রীদের উপর বাড়তি ভাড়া চাপানোয় নীতিগত আপত্তি রয়েছে মমতার। তাই বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দীনেশ। এ দিকে রেল বাজেট সংসদে পেশ হবে মার্চে। শেষ পর্যন্ত মমতার সম্মতি না পেলে নেত্রীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে কি ভাড়া বাড়ানোর মতো ‘বাস্তবসম্মত’ অথচ ‘সাহসী’ সিদ্ধান্ত দীনেশ নিতে পারবেন? তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে সব স্তরেই। রেল মন্ত্রক চলতি অর্থ বর্ষে অপারেটিং রেশিও (১০০ টাকা আয় করতে যা খরচ হয়) ৯১%-এর কাছাকাছি রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল। কিন্তু ভাড়া না বাড়ানোয় তা ছোঁয়া অসাধ্য বলেই মনেই করছেন কর্তারা। কিছু রেল কর্তার কথায়, বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে ১০০ টাকা আয় করতে গিয়ে ১০০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। লাভ তো দূরের কথা, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৫% শতাংশ আয় কম করেছে রেল।
কোষাগারের এই বেহাল অবস্থা দেখে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে বাতানূকুল শ্রেণিতে ভাড়া বাড়ানোর জন্য মমতার কাছে আবেদন করেছিলেন দীনেশ। যুক্তি ছিল, ওই শ্রেণির যাত্রীদের অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার সামর্থ রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। পরে কেবলমাত্র ডিজেল বা জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি তথা ডায়নামিক প্রাইসিং-এর প্রস্তাব নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনা করেন দীনেশ। দীনেশ বলেছিলেন তেল সংস্থাগুলি যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলের দর অনুযায়ী তেলের দাম পর্যালোচনা করে, তেমনি ডিজেলের দামের ওঠাপড়া অনুযায়ী রেলের ভাড়া ঠিক করা হোক। মমতা সেই প্রস্তাবই নয়, দূরপাল্লার ট্রেনের ভাড়া ১০ এর গুণিতকে অর্থাৎ ‘রাউন্ড অফ’ করার যে পরিকল্পনা দীনেশের ছিল সেটিকেও হিমঘরে পাঠিয়ে দেন।
এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রক কিন্তু মনে করছে, যাত্রী ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। কেন না, যে ভাবে ফি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে ‘ইনপুট কস্ট’ (বেতন, ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্য, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ) বেড়েছে তাতে ৯ বছর ধরে একই ভাড়ায় যাত্রীবহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে রেলের কাছে। যার স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে রাজধানী বা শতাব্দীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলি ছাড়া অন্য গাড়িগুলিতে যাত্রী পরিষেবা প্রায় উধাও। রক্ষণাবেক্ষণ নেই বললেই চলে। যাত্রী নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে ফি দিন। বেড়ে গিয়েছে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যাও। একই ভাবে নয় বছর আগেকার দামে খাবার দিতে গিয়ে আপস করতে হচ্ছে খাবারের গুণমানের সঙ্গে। ফলে বাড়ছে যাত্রী-অভিযোগ।
যোজনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রক যে ভাবে আত্মনির্ভর হতে বলছে বলছে রেলকে তাতে পরিষেবা ও নিরপত্তা-সহ সামগ্রিক উন্নতি করতে গেলে ভাড়া বাড়িয়েই তার অর্থ জোটাতে হবে মন্ত্রককে। দলনেত্রীর আর অন্য সব মহলের চাপের মাঝে বাজেটে কোন পথে হাঁটবেন ত্রিশঙ্কু দীনেশ। |