লক্ষ্য দুই, প্রস্তুতি এক |
উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স—
দুটি পরীক্ষা দুই রকমের।
অথচ প্রস্তুতি নিতে হয় একই সঙ্গে। কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়!
লিখছেন ঠাকুরপ্রসাদ ভট্টাচার্য |
সামনেই
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। আর ঠিক তার পিছনেই রাজ্য ও সর্বভারতীয় জয়েন্ট পরীক্ষার পালা। পাশাপাশি দুই পরীক্ষা কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, যারা উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে তারা জয়েন্ট-এ ততটা ভাল করে না। আবার উল্টোটাও হয়। যাদের একমাত্র লক্ষ্য জয়েন্ট-এ ভাল করা, তারা হয়তো সেটাই করে, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল সে রকম হয় না। কেন এটা হয়? দুটো পরীক্ষার ভার কি বড্ড বেশি হয়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য? নাকি দুটো পরীক্ষার ধরনে কিছু গুরুতর পার্থক্য আছে, যেগুলো খেয়াল করা হয় না বলে দুই পরীক্ষায় সাফল্য অধরা-ই থেকে যায়?
শেষের কথাটা সত্যি। প্রথম কথাটাও। কিন্তু দুটি পরীক্ষার আলাদা আলাদা বিশেষত্বর দিকে খেয়াল রেখে পড়লে কিন্তু পরীক্ষার দুটির ভার সামলানোও সহজ হয়। কতগুলো মৌলিক কথা মনে রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে। উচ্চ মাধ্যমিক এমন একটি পরীক্ষা যেখানে সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ, দুই ধরনেরই প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাই করা হয়:
১) পাঠ্য বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় খুঁটিয়ে পড়া হয়েছে কিনা,
২) বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপপাদ্য (থিয়োরেম) এবং সূত্রগুলি (ল) বুঝেছ কিনা,
৩) গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত উত্তর লেখার দক্ষতা এসেছে কিনা,
৪) বোধমূলক, জ্ঞানমূলক, বিশ্লেষণমূলক ও গাণিতিক সমস্যার সমাধান দক্ষতা হয়েছে কিনা তা জানা,
এবং
৫) তথ্যমূলক জ্ঞান কেমন হয়েছে তা-ও দেখা হয় বিভিন্ন অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে। উপরিউক্ত সব বিষয়ে বিচার করা হয় লেখার মান (কোয়ালিটি) ও তার উপস্থাপনার ধরন (রিপ্রেজেন্টেশন)। অর্থাৎ লেখার দক্ষতা (রাইটিং স্কিল)-এর ওপর নির্ভর করবে সাফল্য। আর এখানেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার সঙ্গে পার্থক্য। এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সবই মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন (এম সি কিউ)। ফলে এখানে লেখার উৎকর্ষ যাচাইয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। এম সি কিউ পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীর সম্পূর্ণ অন্য ধরনের গুণাবলি বিচার করা হয় যা উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের প্রশ্নপত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, উচ্চ মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রে জানতে চাওয়া হয়েছে ‘ঘর্ষণ কাকে বলে?’ তুমি উত্তর লিখলে ‘ঘর্ষণবল এক প্রকারের স্পর্শজনিত বল এবং যখন দুটি বস্তুসংস্থার পারস্পরিক তলের মধ্যে গতির সঞ্চার ঘটে তখন ঘর্ষণ বল সর্বদাই গতির বিরুদ্ধে কাজ করে।’ এই উত্তরের মধ্যে একটি অতি সূক্ষ্ম ভুল থেকে গেল যা হয়তো অনেক ছাত্রছাত্রী প্রথমে ধরতেই পারবে না।
এ বার আমরা রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ঘর্ষণেরই একটি এম সি কিউ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
প্রশ্ন: ‘সাইকেল যখন সামনের দিকে চলে তখন সামনে ও পেছনের চাকাতে ঘর্ষণ বলের অভিমুখ হবে...’
অপশন রয়েছে:
ক) উভয় চাকাতে সামনের গতির দিকে,
খ) উভয় চাকাতে গতির বিপরীতে,
গ) পিছনের চাকাতে গতির দিকে ও সামনের চাকাতে গতির বিপরীতে,
ঘ) পিছনের চাকাতে গতির বিপরীতে ও সামনের চাকাতে গতির দিকে।
সাধারণ টেক্সট বই পড়ে অধিকাংশ ছাত্রই উত্তর লিখবে (খ) উভয় চাকাতে গতির বিপরীতে। এই উত্তর সাপেক্ষে যুক্তি হল ঘর্ষণ বলের সংজ্ঞা যা আগেই উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রছাত্রীরা লিখেছে। আর সেটা থেকেই সাধারণ ভাবে মনে হবে ঘর্ষণ বল সর্বদাই গতির বিরুদ্ধে কাজ করে। আর ঠিক এখানেই হল ছাত্রছাত্রীদের বোঝার ভুল। সঠিক উত্তরটা হবে (গ)। অর্থাৎ, পিছনের চাকাতে গতির দিকে ও সামনের চাকাতে গতির বিপরীতে। কারণ ঠিক ধারণাটি হল ‘ঘর্ষণ বল সর্বদাই দুই স্পর্শতলের আপেক্ষিক গতির বিরুদ্ধে কাজ করে’। বিষয়টি বিশদে কিন্তু ধাপে ধাপে আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধে হবে।
সাইকেলের পেছনের চাকা হল চালক চাকা (ড্রাইভিং হুইল)। আমরা প্যাডেল চেন-এর মাধ্যমে প্রথমে পেছনের চাকাতে ঘূর্ণন গতি সৃষ্টি করি।
পেছনের চাকার এই ঘড়ির কাঁটার অভিমুখ ঘূর্ণন গতির (যেহেতু গাড়ি সামনের দিকে যাচ্ছে) জন্য মাটি সাপেক্ষে চাকার স্পর্শ বিন্দু (পয়েন্ট অব কনট্যাক্ট) সর্বদাই মাটির সাপেক্ষে অনুভূমিকভাবে সামগ্রিক গতির বিরুদ্ধে যেতে চায়। ফলে মাটি এই আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেবে উভয়ের স্পর্শতলে চাকার ওপর সামনের দিকে ঘর্ষণ বল সৃষ্টির মাধ্যমে।
|
|
এই পেছনের চাকাতে তৈরি ঘর্ষণ বলই সাইকেলের সামগ্রিক অনুভূমিক গতির সঞ্চার ঘটাতে সাহায্য করে।
সাইকেলের অনুভূমিক গতি সৃষ্টি হওয়ার দরুণ সামনের চাকা মাটি সাপেক্ষে সামনের দিকে পিছলে যেতে চায়। ফলে আবার মাটির সামনের চাকার এই পিছলে যাওয়া (আপেক্ষিক গতি) আটকাতে সামগ্রিক গতির বিপরীতে ঘর্ষণ বল সৃষ্টি করবে।
সামনের চাকাতে সৃষ্ট ঘর্ষণ বল চাকার কেন্দ্রের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় টর্ক দেবে এবং সামনের চাকাও এর ফলে ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে ঘুরতে থাকে।
(গ)-এর উত্তরটি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি ধারণার ওপর:
১) ঘর্ষণ বল আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেয়।
২) ঘূর্ণন গতি বিদ্যা (রোলিং মেকানিক্স)। মজার ব্যাপার হল উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে প্রথম ধারণার (ঘর্ষণ বল আপেক্ষিক গতিকে বাধা দেয়) চর্চা একাদশ শ্রেণিতেই বেশি হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ধারণার (ঘূর্ণন গতি বিদ্যা) প্রয়োগ দ্বাদশ শ্রেণিতে হালকাভাবে পড়ানো হয় বলে অনেক ছাত্রছাত্রীই এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে
পারে না।
|
এম সি কিউ ধরনে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কয়েকটি বিশেষ দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। |
মানসিক সক্রিয়তা |
তুমি কত দ্রুত প্রশ্নটা পড়ছ এবং সমাধানের চেষ্টা করছ, তার বিচার হয়। সাধারণত এই ধরনের প্রশ্নপত্রে আশি থেকে একশোটা মতো প্রশ্ন থাকে। সময় দেওয়া হয় দু’ঘন্টার মতো। সুতরাং, প্রশ্ন পড়া, চয়েস দেখে চিন্তা করা, সমাধান করা ও শেষে ঠিক উত্তরে চিহ্ন দেওয়া এই সব কিছুর জন্য মোট সময় থাকবে এক থেকে দেড় মিনিট। এর জন্য বাড়িতে তোমাকে ঘড়ি ধরে অনুশীলন করতে হবে। কত তাড়াতাড়ি কোনও প্রশ্ন সমাধান করা যায় তার জন্য তোমাকেই পথ বার করতে হবে। যত তুমি এই ভাবে প্র্যাক্টিস করতে থাকবে তত তোমার টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিল এবং স্পিড, দুটোই বাড়বে।
|
বিভিন্ন রকম জ্ঞানের সমন্বয় দক্ষতা |
জয়েন্টে একটি প্রশ্নের উত্তর করতে হয়তো একাধিক বিভাগের জ্ঞান প্রয়োগ করে সমাধান করতে হয়। অর্থাৎ প্রশ্নটি পড়েই তোমাকে বুঝে নিতে হবে কোন কোন বিভাগ এবং তার অধ্যায়ের জ্ঞান লাগবে প্রশ্নটি উত্তর করতে। মনে রেখো, সময় কিন্তু হাতে মাত্র এক থেকে দেড় মিনিট।
|
মত প্রকাশের দক্ষতা |
এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে তোমাকে সব ক’টি প্রশ্নেরই যে উত্তর করতে হবে এমন কিন্তু নয়। কারণ, এখানে এমন বেশ কিছু প্রশ্ন থাকবে যেগুলি তোমরা পারলেও সময়ের অভাবে শেষ করতে পারবে না। আবার এমনও প্রশ্ন থাকবে যেগুলি তোমরা হয়ত করে এসেছ, কিন্তু হলে বসে সেগুলি করতে গিয়ে প্রচুর সময় নিয়ে ফেললে। সুতরাং সময়ের উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করতে তোমাদের কিছু প্রশ্ন ছাড়তেই হবে। তোমাদের দ্রুত চিন্তা করে ঠিক করতে হবে কোন কোন প্রশ্ন লিখবে, কোন প্রশ্নগুলি ছেড়ে দেবে।
|
শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার যাচাই |
পশ্চিমবঙ্গের জয়েন্ট দিয়ে যারা কোনও একটি বিভাগে ভর্তি হতে চায় (ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি), বিরতি সহ তাদের দু ঘন্টা করেও পাঁচ ঘন্টা পরীক্ষা দিতে হয়। আর যারা দুটো বিভাগেই পরীক্ষা দেবে তাদের সব মিলিয়ে আট ঘন্টা পরীক্ষার পরিবেশে থাকতে হবে। এর জন্য পরীক্ষার দিনে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা সর্বোচ্চ সীমায় থাকতে হবে।
|
রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স এবং সর্বভারতীয় জয়েন্ট এন্ট্রান্স-এর প্রস্তুতির পার্থক্য কী, জানা দরকার সেটাও। |
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার সিলেবাস পুরোটাই উচ্চ মাধ্যমিক সংসদের রচিত সিলেবাস সামনে রেখে তৈরি। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরের বাকি সব পরীক্ষার সিলেবাস কিন্তু কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ ও শিক্ষা বিভাগের পরিচালিত সি বি এস ই বোর্ড রচিত সিলেবাস মেনে তৈরি হয়। তাই পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। যেমন, সর্বভারতীয় মেডিক্যাল জয়েন্টে (অল ইন্ডিয়া প্রি মেডিক্যাল/ প্রি ডেন্টাল এন্ট্রান্স এগজামিনেশন, এ আই পি এম টি) উদ্ভিদবিদ্যা (বটানি)-র প্রশ্ন থাকে বেশি আর প্রাণিতত্ত্ববিদ্যা (জুঅলজি) ও শরীরতত্ত্ববিদ্যার (ফিজিয়োলজি) প্রশ্ন থাকে কম। আবার জিনতত্ত্ববিদ্যা এবং আধুনিক জীববিদ্যার ওপরেও অনেক প্রশ্ন থাকে সর্বভারতীয় পরীক্ষায়। কিন্তু রাজ্য জয়েন্ট-এ শরীরতত্ত্ববিদ্যা ও প্রাণিতত্ত্ববিদ্যার প্রশ্নের সংখ্যা উদ্ভিদবিদ্যার প্রশ্নের থেকে অনেক বেশি থাকে। আর আধুনিক জীববিদ্যার প্রশ্ন প্রায় থাকে না বললেই চলে। তা ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক ও সি বি এস ই বোর্ডের সিলেবাস এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাসের বিভাজনেও বিস্তর ফারাক আছে। এমন অনেক অধ্যায় আছে যেগুলি উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে একাদশ শ্রেণিতে পড়ানো হয়, কিন্তু সর্বভারতীয় বোর্ডের ক্ষেত্রে এগুলি থাকে দ্বাদশ শ্রেণিতে। ফলে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষা দেওয়ার সময় অন্যান্য রাজ্যের বা বোর্ডের ছেলেদের তুলনায় বেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে।
সি বি এস ই বোর্ডে দ্বাদশ শ্রেণির পদার্থবিদ্যায় ইলেকট্রো ম্যাগনেটিজম, আধুনিক পদার্থবিদ্যা এবং আলোক তরঙ্গের (ওয়েভ অপটিক্স) মতো বিষয় যতটা জোর দিয়ে পড়ানো হয় উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে কিন্তু এদের ততটা জোর দেওয়া হয় না। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা (অল ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্স এগজামিনেশন, এ আই ই ই ই)-এ গণিতের বিভাগে ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি (থ্রি-ডি জিয়োমেট্রি), ভেক্টর ম্যাথমেটিক্স, পরিসংখ্যান গণিতবিদ্যা (স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যাথমেটিক্স), প্রয়োগমূলক কলনবিদ্যা (অ্যাপ্লিকেশন অব ক্যালকুলাস), আধুনিক বীজগণিত (মডার্ন অ্যালজেব্রা)-এর ওপর ভাল মতোই জোর দেওয়া হয়। প্রশ্নও থাকে। কিন্তু আমাদের রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্সে এই সব বিষয়ের ওপর প্রশ্ন খুব কম থাকে বা তেমন থাকেই না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এবং সর্বভারতীয় সব জয়েন্ট পরীক্ষার মধ্যে সিলেবাস ছাড়াও পরীক্ষায় প্রশ্নগতও অনেক পার্থক্য থাকছে। তাই যারা রাজ্য ছাড়াও সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষা দিতে চায় তাদের প্রথম থেকে এই পার্থক্য বুঝে প্রস্তুতি নিতে হবে।
|
ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরামর্শ |
তা হলে বোর্ড ও জয়েন্ট এন্ট্রান্স, দুটো পরীক্ষাতেই কী করে সমানভাবে সফল হওয়া যায়? এর জন্য কিন্তু প্রস্তুতি শুরু করতে হবে মাধ্যমিকের পর থেকেই। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই তোমাকে তোমার পছন্দের বিষয় ঠিক করে নিতে হবে। যদি মাধ্যমিকে তোমার জীববিদ্যা ভাল লেগে থাকে তা হলে জয়েন্ট-এ মেডিক্যাল-এর জন্য জোর কদমে পড়াশোনা শুরু করে দাও। তবে, মেডিক্যাল-এ যারা বসবে তাদের কিন্তু বেশি জোর দিতে হবে পদার্থবিদ্যায়। কারণ এ ক্ষেত্রে সবাই সমান গুরুত্ব দেবে জীববিদ্যা ও রসায়নে। আর তুমি যদি অঙ্ক এবং ভৌতবিজ্ঞান বেশি পছন্দ করো তা হলে উচ্চ মাধ্যমিকে তুমি প্রস্তুতি নিতে পারো ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার জন্য। কিন্তু বিষয় নির্বাচনের সময় নম্বরকে কখনওই মূল কারণ ধরবে না। তোমাকেই বুঝতে হবে যে কোন বিষয়টা সত্যিই তোমার ভাল লাগে, সেটাকে তুমি মন থেকে ভালবাসো।
|
পাঠ্যবই-এর বিকল্প নেই |
এক বার তুমি যদি তোমার পছন্দের বিষয় ঠিক করে নিতে পারো তা হলেই অনেকটা কাজ কিন্তু এগিয়ে গেল। এর পর তোমার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে যায়। যেমন, বই নির্বাচন। খুব ভাল পাঠ্য বই লাগবে। সেই সঙ্গে লাগবে কিছু রেফারেন্সের বই যেগুলি বিষয়টির ওপর তোমার কনসেপ্ট বা ধারণা আরও ভাল করতে সাহায্য করবে। আর চাই এম সি কিউ প্রশ্নের কিছু টেস্ট পেপার। এই ধরনের বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারো। এ ছাড়াও তোমাদের দাদা-দিদি, যারা এক-দু বছর আগে এই সব পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেছে তাদের সঙ্গেও এক বার কথা বলে দেখো।
|
ঠিকঠাক পরিকল্পনা |
যে কোনও কাজের মতো পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও একটা ভাল পরিকল্পনা প্রয়োজন। চলো, একটা চেষ্টা করা যাক।
১) পাঠ্য বইয়ের কোনও এক অধ্যায় পড়ে নিয়ে বিষয় সম্পর্কে একটা প্রাথমিক জ্ঞান তৈরি করো।
২) একই অধ্যায়ের ওপর কোনও ভাল রেফারেন্স বই থেকে ধারণা পরিষ্কার করো। (প্রথম দুটি ধাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখনকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী পাঠ্য বই না পড়ে বিভিন্ন শিক্ষকের তৈরি নোট পড়ে বিষয়টির ওপর জ্ঞান তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ছাত্রদের বোঝার ক্ষেত্রে অনেক ফাঁক থেকে যায়। পাঠ্য বই না পড়ে শুধু মাত্র এম সি কিউ-এর টেস্ট পেপার সলভ্ করলে বা কয়েকটি মক টেস্ট দিলেই সাফল্য না-ও পেতে পারো।)
৩) টেক্সট বই ও সঙ্গে রেফারেন্স বই ভাল করে পড়ে একটা নোট খাতা তৈরি করে সেখানে যা বুঝেছ সেটার একটা সংক্ষিপ্তসার লিখে ফেলো। (পরীক্ষার আগে রিভিশন করার সময় এই ধাপের কোনও বিকল্প নেই। কারণ পরীক্ষার সময় তুমি পুরো পাঠ্য বইটি পড়ার সময় নাও পেতে পারো।)
৪) এম সি কিউ-এর টেস্ট পেপার থেকে প্রতিটি অধ্যায়ের ওপর কমপক্ষে দুটো সেট পরীক্ষা দাও। যদি দেখ এই মক টেস্টে সাফল্য ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে তা হলে পরের অধ্যায়ে চলে যাও। আর যদি ৭০ শতাংশের কম পাও, তবে আবার অধ্যায়টি নতুন করে পড়তে হবে।
এই ভাবে পরিকল্পনা করে পড়তে পারলে দেখবে ক্রমে নিজের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। তোমার নিজেরই তখন মনে হবে যে অন্যের সাহায্য ছাড়াই তুমি প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষমতা রাখো। আর এই আত্মবিশ্বাস তোমাকে পরীক্ষার সময় অনেক অজানা প্রশ্ন ঠিক মতো সামলাতে সাহায্য করবে। আসলে ‘আমি কতটা জানি’র থেকেও দামি ‘আমি কতটা পারি’ এই মানসিক ধারণা। আর তোমরা যদি লিখে লিখে পাঠ্য বই পড়ার অভ্যাস করতে পারো তা হলে তোমাদের দু ভাবে উপকার হবে এক, উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করার জন্য প্রয়োজনীয় লেখার দক্ষতা বা রাইটিং স্কিল গড়ে উঠবে; দুই, মস্তিকের সঙ্গে হাতের একটা সমন্বয় তৈরি হবে যা তোমাদের এম সি কিউ পরীক্ষায় খুব সাহায্য করবে।
|
অভিভাবকদের উদ্দেশে |
এখনকার ছাত্রছাত্রীরা এমনিতেই যথেষ্ট আত্মসচেতন হয়। কেরিয়ার গঠনের চাপ তারা ঠিকই নিতে পারে। তবে এই গঠনের পেছনে অভিভাবকদেরও বড় ভূমিকা থাকে। তাদের ভূমিকাটা কিন্তু সন্তানের হয়ে বিষয় নির্বাচন নয়, বরং অনেকটা সাহায্যকারী বন্ধুর মতো, ওদের পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক চাপ নিতে পারার ভূমিকা। ওদের নিজেদের মতো বিষয় বাছাই করার স্বাধীনতা দিন। অনেকেই ছেলেমেয়েদের এক গাদা কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দিয়ে মনে করেন, সন্তানের সাফল্য ঠেকায় কে? তার থেকে বিষয়ভিত্তিক ভাল বই কিনে দিয়ে ওদের ভাল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বিষয়-সম্পর্কিত নানা ধরনের বই যতই ওরা পড়বে, ততই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হবে। শিক্ষক কোনও বিষয় পড়িয়ে দিলেই কিন্তু পড়ার বিষয়টি কারও আয়ত্তে চলে আসে না। নিজেকে প্রচুর সময় দিতে হয় বিষয়টি পড়ে ঠিকঠাক বোঝার জন্য।
মাঝেমধ্যে সন্তানের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আপনারাও একটু আধটু আড্ডা দিন। দেখবেন, এতে ওদের মনে আনন্দ থাকবে আর পড়াশোনাও ভাল হবে। বাড়ির সুস্থ পরিবেশ সন্তানের পড়াশোনা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ। শুধুমাত্র কেরিয়ার ও নম্বরসর্বস্ব পড়াশোনা করালে সন্তানের সার্বিক উন্নয়ন কখনওই হবে না। বরং পড়াশোনার সঙ্গে ওর মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধও গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। দেখবেন, সাফল্য আসবেই। |
|
লেখক আরসিসিআইআইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
|