প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে মৃদু অনুযোগই করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “দিল্লি থাকার সময় অনেক ক্ষেত্রেই তো দু’চার দিন কথা হয় না। তা হলে, পশ্চিমবঙ্গে এলেই ডাকাডাকি কেন?”
জবাবে কপট ভর্ৎসনা করে ইন্দিরা বলেছিলেন, “তুমি তো রাজ্যের মন্ত্রী নও! কেন্দ্রের।”
বহরমপুর সার্কিট হাউসে বসে স্মৃতিতে ডুব দিয়ে ঘটনাটি তুলে আনলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাত গভীর, তাই অবিরাম দর্শনার্থীর ভিড় কিছুটা ক্ষীণ। ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে ওই কথোপকথনের যুগে তিনি ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। সময়ের চাকা গড়ানোয় আজ তিনি জঙ্গিপুরের জননেতা।
জননেতা? প্রণব মুখোপাধ্যায়?
রঘুনাথগঞ্জ থেকে লালগোলা উপছে পড়া আমজনতার ভিড় তো তাই বলছে। কোথাও তিনি চশমা দিচ্ছেন রুগিকে, কোথাও বিবাহমণ্ডপের হতদরিদ্র অঙ্গনে বসে গুড়ের চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ইনি নর্থ ব্লক অথবা সংসদের পরিচিত কৌটিল্য, মনমোহন-সনিয়ার মুশকিল আসান, বিদেশে ভারতের কৌশলী দূত নন। নিছকই জঙ্গিপুরের সাংসদ।
ভাঙা পথের রাঙা ধুলো উড়িয়ে আর খানাখন্দে গোঁত্তা খেতে খেতে প্রণবের কনভয় ছুটছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে হাফ প্যান্ট আর আদুড় রোগা শরীরগুলো। আলপথে সাইকেল শুইয়ে ছুটে আসছে ‘দাদু’, ‘দাদু’ বলে চিৎকার করতে করতে। নবগ্রামে যেই নামল তাঁর হেলিকপ্টার চতুর্দিকে যেন ফুটবল ম্যাচ দেখতে আসার ভিড়। গোটা মাঠ হাত নাড়তে নাড়তে চক্রাকারে ঘুরে যে ভাবে অভিবাদন জানালেন সরকারের ‘দু’নম্বর’, দিল্লির রাজনৈতিক করিডর তেমনটা দেখেনি কখনও।
“দীর্ঘ আট বছরের চেষ্টায় একটি জিনিস অর্জন করেছি। এখানকার সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা”, বলছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১০ সালে বাঘা গ্রামে ইউকো ব্যাঙ্কের শাখা উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। ফেরার পথে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে সমবেত গ্রামবাসী করজোড়ে প্রার্থনা করেছিল, ব্যাঙ্ক তো হল। কিন্তু রাস্তা পাকা না হলে বর্ষাকালে ওই ব্যাঙ্ক তো অগম্যই থাকবে। তখন থেকেই বিষয়টি মাথায় ছিল। ইউকো ব্যাঙ্কের কর্তাদেরই প্রণববাবু অনুরোধ করেন, তাঁদের ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’-র আওতায় এই কাজকে নিয়ে আসতে। সেই কাজ সমাপ্ত হয়েছে। গত কাল তার উদ্বোধনে এসে তাই জঙ্গিপুরের সাংসদ তৃপ্ত গলায় জানাচ্ছেন, “আজ সত্যিই এক ঐতিহাসিক দিন।”
জঙ্গিপুরের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র জুড়ে গরিবগুর্বো মানুষের এই সব ছোটখাটো ইতিহাস ছড়ানো। অথচ এখানেই এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রণববাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “মুর্শিদাবাদ এক সময় পূর্ব ভারত শাসন করত। এখানকার টাঁকশালে তৈরি মুদ্রার ব্যবহার ছিল গোটা দেশে। ঔরঙ্গজেব এখান থেকেই স্বর্ণমুদ্রা বানিয়ে নিয়ে যেতেন।” এই ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রণব মুখোপাধ্যায় অনুরোধ করেন ভারতীয় মুদ্রা নিগমকে মুর্শিদাবাদের জন্য এগিয়ে আসতে। ফলস্বরূপ অমৃতকুণ্ড, চারগাছি, বুন্দাইডাঙাতে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে দিয়েছে মুদ্রা নিগম। সেই সঙ্গে একটি সেকেন্ডারি স্কুলও। এগুলি উদ্বোধন করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর স্বগতোক্তি , “আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামের স্কুলগুলোর যা ছিরি ছিল, বলার নয়। এখনকার গ্রাম দেখলে তা আন্দাজও করা যায় না।” |
ফুড পার্ক থেকে উচ্চতর ম্যানেজমেন্ট কলেজ, রাইস মিল থেকে চার লেনের রাস্তা কেন্দ্রের সহায়তায় একের পর এক প্রকল্পের যজ্ঞ চলছে এখানে। শক্তিশালী কংগ্রেসের সংগঠনও। তৃণমূলের পতাকাও চট করে চোখে পড়ছে না কোথাও। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা জানাচ্ছেন, ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ১৪ জন জেতা প্রার্থীকে টিকিট দেয়নি তৃণমূল নেতৃত্ব। তারই জেরে এখানে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগঠন।
২০০৪-এ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর প্রণববাবু তাঁর নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের জন্য অর্থ এবং একের পর এক প্রকল্প নিয়ে এসেছেন দিল্লি থেকে। তবুও সমস্যা প্রতিনিয়ত এবং রাত পর্যন্ত প্রণববাবু বৈঠক করে চলেছেন তাঁর ব্লক স্তরের নেতাদের সঙ্গে। সমস্যাগুলি অভিনব এবং তৃণমূল স্তরের। নূরপুর থেকে জঙ্গিপুর আসার জন্য ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ স্লুইস গেট ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে না। কথা দেওয়া সত্ত্বেও রেল ইজ্জত সার্টিফিকেট দিচ্ছে না স্থানীয় বিধায়কদের হাতে। অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা তৈরির কাজ করা যাচ্ছে না। বাধা দিচ্ছেন কিছু বিজেপি ঘেঁষা নেতা।
প্রতিটি সমস্যারই সাধ্যমতো সমাধান খুঁজছেন সাংসদ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নিচ্ছেন দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর তারই মাঝে শাঁখারিপাড়ার গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান দিন মহম্মদ বিশ্বাসের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াতে বসে কুশল সংবাদ নিচ্ছেন সকলের।
সব সেরে ফেরার সময় তাঁর হেলিকপ্টারের চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে দূর গ্রাম থেকে আসা মানুষের মিছিলের হাত নাড়া শুরু। হাত নেড়েই যাচ্ছে তারা। এই আম আদমি যেন একেবারেই নিজস্ব বাহিনী, দিল্লির দাপুটে কর্তা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। |