|
|
|
|
বাতিলের বুলেটেই বিদ্ধ মোহন-স্বপ্ন |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
প্রয়াগ ইউনাইটেড-২ (ভিনসেন্ট, দীপক)
মোহনবাগান-১ (আনোয়ার) |
বুলেটের মতো যে বিশ্বমানের শটটা মোহনবাগানের জালে আছড়ে পড়ল, তা আসলে এক সঙ্গে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল। কিংবা বলতে চেয়েছিলেন শুটার নিজেই।
— আমাকে ওদের কর্তারা বাতিল করে দিয়েছিল না?
— ওদের টিডি বলেছিল না, ইউনাইটেড অবনমনের টিম?
— জাতীয় দলে এত বছরেও আমায় অধিনায়ক করা হয়নি, না?
‘অর্জুন’ দীপক মণ্ডল। মোহনবাগান তাঁকে দুচ্ছাই করে দিয়েছিল। জাতীয় সংস্থার কর্তারা ভাইচুংকে সম্মান দিতে বায়ার্ন ম্যাচে ডেকেছিলেন। দীপককে মনে রাখেননি। তাঁর জন্য কোনও তদ্বির করেননি কেউ। ফুটবলারদের সংস্থাও তো তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি।
যুবভারতীর হার শেষে মোহনবাগান জনতা গালাগাল, হাহাকারে ব্যস্ত। “ডেম্পোর থেকে ন’পয়েন্ট পিছনে, লিগ তো প্রায় গেল!” তখনই দেখা গেল, লাউঞ্জে দীপককে কাঁধে নিয়ে ফিরছেন প্রয়াগের সতীর্থরা। লালকমল ভৌমিকের একটা হাত ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। তিনিও এক হাত নিয়ে দীপককে ধরে। “তেরো বছর আই লিগ খেলছি। জেসিটিতে গোল করেছি। কলকাতায় এই প্রথম গোল। জীবনের সেরা।” লাজুক দীপক যেন অর্জুনের লক্ষভেদ করেছেন। প্রয়াগ-দীপ জ্বালিয়ে। মোহন-তরী ডুবিয়ে।
প্রয়াগ ইউনাইটেড আর মোহনবাগানের ফারাকটা ওখানেই সমুদ্র হয়ে গেল। একটা ক্লাব খেলল সত্যিই ইউনাইটেড হয়ে। অন্যটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক থেকে গেল। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ফুটবলে এ দল জেতে না। রাজ্য সরকারের খাতায় ইউনাইটেডের নাম নেই। তিন প্রধানের মতো কোটি টাকা পায় না। অথচ ডেম্পোর পরে ভারতে সবচেয়ে ধারাবাহিক দল তারাই। |
|
খলনায়ক: বিতর্কিত সেই মুহূর্ত। সুব্রতর সঙ্গে ঝামেলা করে ড্রেসিংরুমের দিকে হাদসন লিমা। |
ম্যাচ চলার সময় মাঠে এ জিনিস বোঝা গেল বারবার। মাঠের বাইরে প্রেসবক্সেও। সার দিয়ে দুটো দলের সুযোগ না পাওয়া ফুটবলাররা বসে। ইউনাইটেড দলটা কত ইউনাইটেড। একটা সুযোগ নষ্ট হলেই চেঁচাচ্ছেন সবাই মিলে। তাঁদের গায়ে একটা ক্লাবের নির্দিষ্ট ট্র্যাকশুটে। মোহনবাগান অতিরিক্তরা এসেছিলেন যে যার পোশাকে। কেউ বান্ধবী নিয়ে। দলের জন্য বাড়তি অনুভূতি, চিৎকার, টেনশন কোথায় তাঁদের? নবি বাদে বাকিরা নির্বিকল্প। ম্যাচটা হারের সময় সমর্থকরা এসে গালাগাল করছিলেন সুনীলকে। সুনীলও পাল্টা হুঙ্কার দিলেন, “আ যা অন্দর।” এই পাল্টা হুঙ্কার যদি সুনীলের সতীর্থরা মাঠে দেখাতেন!
বিশ্বখ্যাত কোচ হেলেনিও হেরেরা বলতেন, “আমার দল পিছিয়ে পড়ে ১-১ করলে আমি নিশ্চিত হই। এ বার জিতব বলে। তখন মনোবল আসলে দ্বিগুণ হয়ে যায়।” সুব্রত-প্রশান্তর দল পরপর দু’দিন পিছিয়ে পড়ে ১-১ করেও হারল। ১৫ মিনিটে গোল খেয়ে ৪ মিনিটের মধ্যে আনোয়ার উঠে গিয়ে গোলটা করলেন। তাতেও মনোবল বাড়ল না। আসলে দলটার অসুখ গভীরে। ফিটনেস খুব খারাপ। কম্বিনেশন প্লে নেই। গতি নেই। চারটের বেশি পাস হচ্ছে না। সেটপিসে গোল্লা। যে দলের মাঝমাঠের দুটো জায়গায় অন্য দলের বাতিল (শুভাশিস রায়চৌধূুরী) ও অনূর্ধ্ব ১৯ (মণীশ ভার্গব) খেলেন, তারা চ্যাম্পিয়ন হবে কী করে? শুভাশিস আবার ইউনাইটেডেই পাত্তা না পেয়ে মোহনবাগানে এসেছেন। দীপকের উল্টো। যা নিয়ে প্রয়াগের কর্তাদের মুখে বিদ্রূপ।
রবিবারে আর একটা ভুল মোহনবাগানের পথ বন্ধ করে দিল। ২৩ মিনিট আগে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার হাদসনকে তুলে নিলেন সুব্রত। হাদসন দারুণ কিছু খেলছিলেন না। কিন্তু দলটার বাকি মাঝমাঠ ছিল অসহ্য। সুব্রতর পুরনো ছাত্ররা জয়ন্ত, দেবদাস, জেমস সেখানে রাজত্ব করছিলেন। হাদসনকেই যা একটু আধটু চোখে পড়ছিল। পাঁচ মিনিট আগে দীপক ২-১ করে ফেলেছেন। সুব্রত হঠাৎই হাদসনকে তুলে নিলেন চোট বলে। তাঁকে জিজ্ঞাসাও করা হয়নি, চোট আছে কি না। প্রয়াগের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর কৃষ্ণেন্দু রায় পর্যন্ত বিস্মিত, “ভটচাজের গেমরিডিংয়ের সবাই অত প্রশংসা করে। ও হাদসনকে তুলল কী করে?”
|
|
নায়ক: দুর্দান্ত গোলের পর সতীর্থদের সঙ্গে দীপক মণ্ডল। |
হাদসন মোহনবাগান জনতাকে খেপিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দেখিয়ে গেলেন, এই দলটায় টিম স্পিরিটের মতো শৃঙ্খলাও যায় যায়! পরে ক্ষমা চাইলেও তাঁর কাছে লিখিত ক্ষমা চাওয়া উচিত ক্লাবের। ম্যাচশেষে সুব্রতকে ঘিরে ধরে কিছু সমর্থক চেঁচাচ্ছিল, কেন হাদসনকে সরানো হল? মোহন-ইস্ট সমর্থকদেরও ফুটবলারদের মতো ধারাবাহিকতা নেই। আজ যাঁর পায়ে পড়ছে, কাল তাঁকে গালাগাল দিচ্ছে। হাদসন ব্যারেটো নন। তিনি থেকেও যে খুব লাভ হত, মনে হয় না। সারা ম্যাচে ওডাফা-ব্যারেটো-ওডাফা মিলে একটা মুভমেন্ট করেছিলেন। সিটার কটা হল? দীপক-বেলো রজ্জাক-অর্ণবের জাঁতাকলে ওডাফা ধূসর পাণ্ডুলিপির পাতা হয়ে রইলেন। বলই পাননি। জয়ন্ত এবং জেমসের দুটো দুর্দান্ত শট সংগ্রাম অনবদ্য সেভ না করলে স্কোর আরও লজ্জায় ফেলত।
মোহন টিডি নিজে সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। কোচ সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার। অথচ দেখুন, মোহনবাগানে মাঝমাঠ এবং রক্ষণ ছন্নছাড়া। মাঝমাঠে মার্কিং, পাসিং, বল ধরা দশ মিনিটের বেশি হল না। প্রয়াগ কোচ সঞ্জয় সেন উল্টো দিকে চমৎকার লালকমলের বিকল্প খুঁজে নিয়েছেন। সুব্রত-প্রশান্ত কিন্তু নবি-জুয়েলদের বিকল্প বের করতে পারলেন না। ম্যাচটায় দুটো দলের এটাও ফারাক।
আর একটা ফারাক ইয়াকুবু। এমনিতে ধারাবাহিকতায় তিনি ব্যারেটোর সঙ্গে তুলনীয়। গোলক্ষুধায় ওডাফার সঙ্গে। রবিবাজারে ব্যারেটো-ওডাফা যখন মন্থর থেকে মন্থরতর হচ্ছেন, ইয়াকুবু তখন বারবার ছোবল মারলেন মোহন ডিফেন্সে। ঘানায় তাঁর পারিবারিক সমস্যা। সব ভুলে ভারতে থেকে যান এই ম্যাচটার জন্য। তাঁর মিশন সফল। ন’পয়েন্ট পিছনে থাকা সুব্রতর মিশনের কী হল? মনে হচ্ছে, দশমীর বাজনা সেখানে। “এখনও অনেক বাকি। চার্চিলও তিন গোল খেল আজ। একটা দল হারলেই সব পাল্টে যাবে।” বলছিলেন সুব্রত।
আসল ধারাপাত পাল্টায় না। একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষথেকে যায়। আই লিগের ধারাপাত বারবার পাল্টাচ্ছে। এখন যেমন একে আর্মান্দো... সাতে সুব্রত।
|
প্রয়াগ ইউনাইটেড: অভিজিৎ, দীপক, অর্ণব, বেলো, চিন্তা চন্দ্রশেখর, জেমস, জয়ন্ত, ডেনসন, শঙ্কর (তুলুঙ্গা), ভিনসেন্ট (জোসিমার), ইয়াকুবু (রফিক)।
|
মোহনবাগান: সংগ্রাম, সুরকুমার, কিংশুক, আনোয়ার, ধনরাজন, মনীশ (গৌরাঙ্গ), শুভাশিস, ব্যারেটো, লিমা (স্নেহাশিস), অসীম (প্রদীপ), ওডাফা। |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
|
|
|
|
|