একেই বলে উভয় সঙ্কট! মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক নিতে গেলে টান পড়ছে জেলা হাসপাতালে, জেলা হাসপাতালে পরিষেবা চালু রাখতে গেলে আটকে যাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজের পঠনপাঠন।
রাজ্যে নতুন তিনটি মেডিক্যাল কলেজ চালু হয়েছে গত বছর থেকে। তার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলা হাসপাতাল থেকে ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওই তিনটি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকের পদে যোগও দিয়েছেন। কিন্তু তার ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলা হাসপাতালগুলির পরিষেবা। অবস্থা সামাল দিতে গত সপ্তাহে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। ওই ৬০ জন চিকিৎসককে বলা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজে তাঁদের নিয়োগ বহালই থাকছে। কিন্তু পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাঁরা যেন জেলা হাসপাতালের কাজই চালিয়ে যান। ফলে এক দিকে ওই চিকিৎসকেরা কার্যত ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়েছেন! অন্য দিকে মেডিক্যাল কলেজ বা জেলা হাসপাতাল, কোথাওই সঙ্কট-মুক্তির স্থায়ী দিশা মিলছে না।
গত বছরে মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার সাগর দত্ত হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজে উন্নীত করা হয়েছে। এমসিআই-এর (মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া) নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞ শিক্ষক প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী নিয়োগের কাজও শুরু হয়ে যায় গত বছরের শেষেই। বিভিন্ন জেলা হাসপাতাল থেকে ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওই তিন মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। কিন্তু ৬০ জনের মধ্যে ৪৫ জনই সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালগুলিতে তাঁদের বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। ফলে তাঁরা ছেড়ে যাওয়ায় সেই বিভাগগুলি কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মেডিসিন, সার্জারি, প্যাথোলজি, অ্যানাস্থেশিয়া, রেডিওলজির মতো বিভাগে চিকিৎসক না-পেয়ে বহু হাসপাতালে কাজকর্ম শিকেয় ওঠে।
পরিস্থিতির চাপে তড়িঘড়ি একটি নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। শিক্ষা-স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ওই ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে আপাতত জেলা হাসপাতাল ছেড়ে মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিতে বারণ করা হয়েছে! অর্থাৎ আপাতত কিছু দিন তাঁরা মাইনে পাবেন মেডিক্যাল কলেজ থেকে, কিন্তু কাজ করে যাবেন জেলা হাসপাতালে! তা হলে নতুন মেডিক্যাল কলেজগুলোর পঠনপাঠনের কী হবে? সুশান্তবাবুর জবাব, “মূল ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলির পঠনপাঠন দ্বিতীয় বর্ষ থেকে শুরু হয়। ফলে প্রথম বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মেডিক্যাল কলেজে যোগ না-দিলেও ক্ষতি নেই।” দ্বিতীয় বর্ষের পঠনপাঠন শুরু হয়ে যাবে জুন-জুলাই নাগাদ। তার আগে সরকার জেলা হাসপাতালের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জোগাড় করতে পারবে? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার উত্তর, “ও ঠিক হয়ে যাবে। নতুন ছেলেরা সব পাশ করবে।
তার মধ্যে অনেকে তো সরকারি চাকরিতে
ঢুকবে। বিজ্ঞাপন দিয়েও বিশেষজ্ঞ নেওয়া হবে।” এপ্রিল মাসে যে নতুন এক ঝাঁক এমডি চিকিৎসক
বেরোবেন, সেই দিকে তাকিয়েই আপাতত আশাবাদী স্বাস্থ্য দফতর।
কিন্তু দফতরের শীর্ষ কর্তাদেরই একাংশ স্বীকার করছেন, এই আশাবাদের খুব বাস্তব ভিত্তি নেই। জেলা হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক পাওয়া বেশ কঠিন হতে পারে। ওই ৬০ জনকে বাদ দিলেও রাজ্য জুড়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল। সেই অভাব মেটাতে সম্প্রতি অ্যাড-হক ভিত্তিতে ৩০০ জন চিকিৎসক নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৪৮ জন কাজে যোগ দিয়েছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে নেওয়া হয়েছিল ২৮ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১১ জন যোগ দিয়েছেন। আবার বিজ্ঞাপন দিলে যে এর থেকে ভাল ফল হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেরই খবর, গত কয়েক মাসে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্বেচ্ছাবসরের আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। যদিও স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার মতে, এই সংখ্যাটা ১৫-২০ জনের বেশি নয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবনের অন্য সূত্রে জানা গিয়েছে, সংখ্যাটা আরও কিছু বেশি। স্বেচ্ছাবসর চাওয়া চিকিৎসকদের অনেকেরই অভিযোগ, জেলা হাসপাতালে কথায়-কথায় স্বাস্থ্যকর্তারা হুমকি দিচ্ছেন, বদলি করছেন। আউটডোরে সময় ধরে না-পৌঁছলে শাস্তি, গাফিলতিতে রোগীর ক্ষতি হলে জরিমানা। এমনকী হাসপাতালে আসা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘সঠিক’ ব্যবহার না-করলেও শাস্তির খাঁড়া। এই ভাবে তাঁদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই তাঁরা চাকরি ছাড়তে চাইছেন।
বস্তুত জেলা হাসপাতাল ছেড়ে যে ৬০ জন চিকিৎসক মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিয়েছেন, তাঁদেরও একই অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, জেলায় চিকিৎসক কম। অথচ রোগীর চাপ মারাত্মক। ফলে পরিষেবা দিতে তাঁদের নাস্তানাবুদ হতে হয়। সামান্য ত্রুটি হলেই রোগীর আত্মীয়স্বজনদের হাতে মারধর থেকে শুরু করে শো-কজ সবই রয়েছে। হাসপাতালের পরিষেবা উন্নত করার নামে ডাক্তার না-বাড়িয়েই তাঁদের উপর বেশি কাজ করার চাপ সৃষ্টি করছে স্বাস্থ্য দফতর। সেই তুলনায় নতুন মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকের চাকরি অনেক ঝঞ্ঝাটবিহীন।
সুতরাং জেলা হাসপাতালে কাজ করার আগ্রহ এমনিতেই যেখানে পড়তির দিকে, সেখানে কী ভাবে আসনগুলি পূরণ করা হবে? যদি পূরণ করা না যায়, তাহলে মেডিক্যাল কলেজগুলির কী হবে? আশাই একমাত্র ভরসা স্বাস্থ্য দফতরের। |