প্রবন্ধ...
সৌজন্য কারে কয়?
ন্দিরা-কংগ্রেস তৈরি হওয়ার ঠিক আগে দল তখন ভাঙনের মুখে। কংগ্রেসে ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে মোহন ধারিয়া, চন্দ্রশেখরেরা ‘তরুণ তুর্কি’। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার পরে মন্ত্রিসভা থেকে তাঁর পদত্যাগের চিঠি নিয়ে সোজা শ্রীমতী গাঁধীর ঘরে পৌঁছলেন মোহন। উত্তেজিত ভঙ্গিতে চিঠি তুলে প্রধানমন্ত্রীকে বললেন: “এই নিন পদত্যাগপত্র। আমি আর এক মুহূর্ত আপনার মন্ত্রিসভায় থাকতে চাই না।” ইন্দিরা রাগলেন না। পাল্টা কোনও উত্তেজনার চিহ্ন নেই তাঁর মুখে। শান্ত স্বরে বললেন: “মোহন, আমি তোমার এই পদত্যাগপত্র নিতে পারছি না। কারণ আমি তোমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতিকে আগেই নোট পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমাকে বরখাস্ত করা হবে।” মোহন ধারিয়া বুঝে যান, ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে ‘বিপ্লবী নায়ক’ হতে দেবেন না।
স্থান-কাল-পাত্র-পরিপ্রেক্ষিত সব আলাদা। তবু সম্প্রতি মহাকরণের অলিন্দে মনোজ চক্রবর্তী মশাইয়ের আস্ফালন দেখে ইতিহাসের পাতায় চলে যাওয়া ওই ঘটনাটি ফের মনে পড়ল। গত কয়েক দিন প্রায় নিয়মিত ভাবে হাকরণে বা অন্যত্র খোলা গলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অসংযত ভাষায় আক্রমণ করেছেন তাঁরই সরকারের প্রতিমন্ত্রী কংগ্রেসের মনোজবাবু। টিভি ক্যামেরার সামনে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে চিঠি দেখালেও সেই চিঠি জায়গা মতো অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দিতে বিস্তর টালবাহানা ছিল তাঁর। বরং কংগ্রেস হাইকম্যান্ড থেকে ‘নির্দেশ’ আসার দোহাই দিয়ে সরকারি সব সুযোগসুবিধা, গাড়ি, অফিস, সচিব ইত্যাদি বজায় রেখেই তিনি সরকার-বিরোধী (পড়ুন, মমতা-বিদ্বেষী) রাজনীতির পালে হাওয়া জুগিয়ে যাওয়ার খেলা খেলে গিয়েছেন সপ্তাহখানেক। তাতে মমতা জিতবেন, না মনোজ সেই প্রশ্নে অবশ্য ঘোড়াও হাসি চাপতে পারত না। এবং প্রত্যাশিত ভাবেই মনোজবাবুকে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেওয়ার ‘অনুমতি’ দিয়েছেন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড।
কিন্তু যে প্রশ্নটা ভাবায়, তা এক দিকে শালীনতা ও সৌজন্যবোধ এবং অন্য দিকে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব। প্রথমে সৌজন্যের প্রশ্ন। মনোজবাবুর ক্ষোভ, তাঁকে না-জানিয়ে মমতা তাঁর দফতর ছেঁটে দিয়েছেন। এটা ‘সৌজন্যবিরোধী’। কোনও মন্ত্রীর দফতর রদবদল করার পূর্ণ অধিকার কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর এবং রাজ্যের বেলায় মুখ্যমন্ত্রীদের রয়েছে। তবু তর্কের খাতিরে না-হয় বলা যেতে পারে, মমতা এই রদবদলের সময় মনোজবাবুকে আগে জানালে তাতে মহাভারত খুব অশুদ্ধ হত না।
কিন্তু এক হাতে তালি বাজে না। মনোজবাবু বা তাঁর সমর্থক কতিপয় কংগ্রেস নেতা আজ মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে যে ‘সৌজন্যের অভাব’ দেখছেন, তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে কী ভাবে? তৈরি করেছেন কে? মনোজ চক্রবর্তী নয় কি? রায়গঞ্জ ও মাজদিয়ার দুটি কলেজে উদ্ধত ছাত্র আন্দোলনের কবলে অধ্যক্ষদের নিগ্রহ মনোজবাবুকে উত্তেজিত করেছিল। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও ব্যক্তি ওই রকম ঘটনায় ক্ষুব্ধ হবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মনোজবাবু কী করলেন? তাঁর মন্ত্রীর দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলা শিকেয় তুলে মহাকরণে দাঁড়িয়েই সরকারকে তুলোধোনা করতে শুরু করলেন। বললেন, এই সরকারের ‘মুখ পুড়েছে’। ঘোষণা করলেন, “দল বললে ছেঁড়া স্যান্ডেলের মতো মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বেরিয়ে যাব।” কিন্তু দলও সহসা কিছু বলল না, তিনিও ছাড়লেন না। বরং বুকে বসে দাড়ি ছেঁড়ার কাজটি গুছিয়ে করে চললেন। মনোজবাবুর দল কংগ্রেসের কোনও স্তরের কোনও নেতা সে সময় তাঁকে নিরস্ত করার বা সংযত হতে বলার কোনও চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানা নেই।
নীতি, শৃঙ্খলাবোধ ও সৌজন্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করে মনোজবাবু তো প্রথমেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দিয়ে মহাকরণ থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের প্রমাণ রাখতে পারতেন। তা তিনি করেননি। উল্টে গাছের খেয়ে তলার কুড়োনোটাই উপযুক্ত পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যাতে মন্ত্রিত্বের ‘ফল’ খাওয়া এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ‘বিদ্রোহ’ দুটিই বজায় থাকে।
অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী কী করতে পারতেন? মনোজবাবুকে পদত্যাগ করার ‘সুযোগ’ না দিয়ে তিনি অনায়াসে রাজ্যপালের কাছে তাঁকে বরখাস্তের সুপারিশ করতে পারতেন। মোহন ধারিয়ার বেলায় ইন্দিরা গাঁধী যেমন করেছিলেন। কিন্তু মমতাও সেটা করেননি। কেউ কেউ ভাবতেই পারেন, এটা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতার ‘কর্তৃত্বের’ ক্ষেত্রে একটা দুর্বলতার জায়গা তৈরি করে দিল। প্রথম রাতে বেড়াল মারার আপ্তবাক্য মনে রেখে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি তাঁর সরকারের মন্ত্রী মনোজবাবুর বিরুদ্ধে ‘শৃঙ্খলাহীনতার’ অভিযোগে ‘উপযুক্ত’ ব্যবস্থা নিতেন, তার বার্তা হত সুদূরপ্রসারী।
কিন্তু এটাও ভুললে চলবে না, জোট-রাজনীতির স্বার্থে অনেক কিছুই যে ‘মানিয়ে’ নিতে হয়, তা মমতার চেয়ে ভাল কেউ বোঝেন না। হয়তো তাই, মমতা সব বুঝেও মনোজ চক্রবর্তীর ‘ঔদ্ধত্য’কে চরম ঘা দিতে চাননি। বার্তা দিতে চেয়েছিলেন মনোজবাবুর দফতর কাটছাঁট করে। যদিও এটা ঘটনা, কংগ্রেসের ওই ‘বিদ্রোহী মন্ত্রী’র সঙ্গে তরজায় নেমে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা অনেকেই মহাকরণকে মঞ্চ করে এমন কথাবার্তা বলেছেন, যা সৌজন্যবোধের পরিপন্থী।
জোট-সরকারে ছোটখাটো শরিকি দ্বন্দ্ব কোনও অভিনব ঘটনা নয়। ঢেউ ওঠে, আবার মিলিয়েও যায়। প্রায় সর্বদাই এতে ‘জয়’ হয় বড় দলের। নিজের দলের মন্ত্রীর সঙ্গে মতভেদেও ব্যক্তিগত স্তরে ‘জয়ী’ হন মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুর সঙ্গে লড়াইয়ে যেমন যতীন চক্রবর্তী থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেউই জিততে পারেননি। যতীন চক্রবর্তীকে সরতে হয়েছিল। মন্ত্রিসভায় ফেরার আগে বুদ্ধদেববাবুকে কার্যত ‘ভুল’ স্বীকার করতে হয়েছিল জ্যোতিবাবুর কাছে। সে সব এখন ইতিহাস।
প্রশ্ন হল, নতুন সরকারের প্রথম পর্বেই কংগ্রেসের মন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সংঘাত’ কি আগামিদিনের জন্য অন্যতর কোনও ইঙ্গিতের সূচনা? রাজনীতি এখন যে খাতে বইছে তাতে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, এই ঘটনাকে বাড়তি গুরুত্ব দিলে তা রজ্জুতে সর্পভ্রমের শামিল হবে। কিন্তু দুটি বিষয় এ থেকে মোটামুটি পরিষ্কার। এক, কংগ্রেসের রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, কেউ এক বারও মনোজ চক্রবর্তীকে তাঁর ওই ‘শৃঙ্খলাভঙ্গকারী’ আচরণের জন্য কোনও রকম ‘তিরস্কার’ করলেন না। তাঁরা শুধু মনোজবাবুকে পদত্যাগের অনুমতি দিলেন। তার মানে কি, মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে এক আধা-মন্ত্রীর বিষোদ্গারে কংগ্রেস প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় জুগিয়ে গেল? দুই, মনোজবাবুর শূন্য পদে কংগ্রেস নতুন মন্ত্রী পাঠাবে কি? পাঠালে বিতর্কে জল ঢালা হয়ে যাবে সহজেই। আর না পাঠালে? প্রদেশ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কংগ্রেস নাকি এখনই অন্য কাউকে মন্ত্রী করবে না। সে ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রশ্ন থেকে যায়, নতুন মন্ত্রী না দিলে কি এটাই বোঝানো যাবে যে, দল মনোজ চক্রবর্তীর ‘বিপ্লব’কেই ঘুরপথে ‘অনুমোদন’ দিয়ে রাখল?
উত্তর এখনই বোঝা কঠিন। তবে দাবা খেলায় অনেক সময় বোড়ে দিয়ে রাজাকে ‘কিস্তি’ দেওয়া যায়। মানতেই হবে, রাজনীতিটাও বিষম দাবার চাল। নইলে মনোজ চক্রবর্তীর মতো এক সামান্য প্রতিমন্ত্রীর ‘ঔদ্ধত্যকে’ কংগ্রেস নেতারা এ ভাবে মুখ বুজে মেনে নিতে পারলেন কেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.