অন্যায় নিবারণ করিতে গিয়া প্রায়ই অধিকতর অন্যায় ঘটিয়া যায়। সম্প্রতি কলিকাতার লেক টাউনে এক স্বল্পবিত্ত পরিবারের ষোড়শী কন্যাকে তাহার বিবাহস্থল হইতে পুলিশ থানায় লইয়া গেল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতেই পারে, তৎপরতাটি যথাযথ। বালিকাবিবাহ অতি গর্হিত কাজ, সন্দেহ নাই। দীর্ঘ কাল ধরিয়াই ইহা ভারতের একটি অভিশাপ, যাহা এই দেশের সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক উন্নতির পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। কিন্তু এই সামগ্রিক সত্যটি যত বড়ই হউক, তাহা এই পরিবারটির আকস্মিক বিপর্যয়কে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করিতে পারে না। কন্যা জানাইয়াছে, তাহার এই বিবাহে অমত ছিল না। পিতা-মাতাও সন্তানের যথাসাধ্য মঙ্গলের চিন্তা করিয়া কন্যার বিবাহে উদ্যোগী হইয়াছিলেন। কন্যার হিতার্থে তাঁহাদের গৃহীত বন্দোবস্তটি হয়তো ভ্রান্ত, কিন্তু গভীরে নিহিত উদ্দেশ্য মন্দ ছিল না ইহা ধরিয়া লওয়া চলে। বহু ব্যয়, বহু আয়োজন তাঁহারা করিয়াই ফেলিয়াছিলেন। বিবাহবাসর হইতে কন্যাকে ‘উদ্ধার’ করিয়া সমাজসেবী সংস্থা ও পুলিশ আইন রক্ষা করিয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু বিবাহ দিবসে আইন-প্রশাসনের কঠিন মুষ্ঠির আঘাত কন্যা ও তাহার পরিবারকে কত দূর বিপন্ন করিয়াছে, তাহাদের সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক সংস্থানকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছে, তাহা সহজেই কল্পনা করা যায়। অসহায় এবং বিব্রত ষোড়শী মেয়েটির মানসিক অবস্থা কী রূপ হইয়াছিল অনুমান করাও দুঃসাধ্য নহে। ঈষৎ সুসংবাদ বলিতে কেবল ইহাই যে, পাত্রটি কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছে। |
তবে কি আইন-প্রশাসন ক্ষণতরে চক্ষু মুদিলেই ভাল হইত? নাবালিকা বিবাহের অভিযোগ লইয়া যে ফোনটি আসিয়াছিল, তাহার ভিত্তিতে ব্যবস্থা না লইলে তাহা নিঃসন্দেহে কর্তৃপক্ষের কাজে গাফিলতি বলিয়াই গণ্য হইত। তাই কাহাকেও দোষারোপের অবকাশ নাই। কিন্তু ন্যায় এবং নীতি লইয়া কিঞ্চিৎ চিন্তার প্রয়োজন হইয়াছে। নীতি বস্তুটি অবিচল। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিবাহ নিষিদ্ধ, নীতি তাহা নির্দিষ্ট করিয়াই দিয়াছে। কিন্তু ন্যায়ের ধারণা আরও ব্যাপক নীতি মানিবার ফল কী হইবে, ন্যায়বিধানের ক্ষেত্রে তাহাও মনে রাখিতে হইবে। না রাখিলে নিষ্পাপ, নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়া হইবে। এইরূপ সংকটের উদাহরণ প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে বারবার পাওয়া যায়। ভীষ্ম যে রাজকন্যা অম্বা ও তাঁহার দুই সহোদরাকে নিজ ভ্রাতার সহিত বিবাহের জন্য হরণ করিয়াছিলেন, তাহা ক্ষত্রিয় নীতিবিরুদ্ধ ছিল না। কিন্তু ভীষ্মের নির্দিষ্ট বিবাহে অনিচ্ছুক ছিলেন অম্বা, তাই তাঁহার জীবনে বিনা দোষে দারুণ সংকট উৎপন্ন হইয়াছিল। অম্বার প্রতি মর্মান্তিক অন্যায় ঘটিয়াছিল। এ ক্ষেত্রে ঘটিয়াছে ইহার বিপরীত বিবাহে ইচ্ছুক ষোড়শী কন্যার বিবাহ রোধ করিয়া নীতি রক্ষা করা হইয়াছে ঠিকই। কিন্তু বালিকাটিকে বিপন্ন, বিপর্যস্ত করা হইয়াছে। তাহার সহিত অন্যায় হইয়াছে, ইহা অস্বীকার করা চলে না। ন্যায়ের পথ সরল নহে। নীতিপ্রয়োগের রীতিতে কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ প্রয়োজন। নহিলে অন্যায় ঘটিয়া যায়। |