নিজের সন্তানদের ফিরে পেতে এ বার রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হল নরওয়ে প্রবাসী বাঙালি পরিবার।
এ বিষয়ে আগেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ওই পরিবারটি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে গোটা বিষয়ে নরওয়ে সরকারের কাছে দু’বার চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু কোনও উত্তরই মেলেনি। তিন বছরের অভিজ্ঞান ও এক বছরের ঐশ্বর্যার জন্য গত বছর থেকেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বাবা-মা অনুরূপ ও সাগরিকা ভট্টাচার্য।
আজ সিপিএম-নেত্রী বৃন্দা কারাটের উদ্যোগে সাগরিকার বাবা-মা, মনোতোষ ও শিখা চক্রবর্তী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের সঙ্গে দেখা করেন। মনোতোষবাবু বলেন, “বিষয়টা শুনে রাষ্ট্রপতি হতবাক হয়ে যান। তিনি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এমনটা হয়েছে।” রাষ্ট্রপতির কাছে আজ মনোতোষ ও শিখাদেবী আবেদন জানিয়েছেন, তিনি যেন সরাসরি নরওয়ের রাজাকে এ বিষয়ে
চিঠি লেখেন।
বৃন্দা কারাট বলেন, “গোটা পরিবারের জন্য এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ওঁরা নরওয়ের আদালতেও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাগরিকা কেন তাঁর শিশু কাঁদলেই স্তন্যপান করান, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সে দেশের শিশু কল্যাণ বিভাগ। অভিযোগ, শিশুকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। তাই জন্য তাঁর চার মাসের দুধের শিশুকে তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওদের দেশের এটাই ব্যবস্থা। সব চেয়ে বড় সমস্যা, আমাদের বিদেশ মন্ত্রকের চিঠিরও কোনও জবাব দিচ্ছে না নরওয়ে।” এ বিষয়ে মহিলা সংগঠনগুলিকে নিয়ে প্রচার চালানোর পাশাপাশি আগামী সপ্তাহে তাঁরা দিল্লিতে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করবেন বলে জানিয়েছেন বৃন্দা। তাঁর মতে, “ওই শিশুদের ফেরাতে ভারত সরকার কড়া পদক্ষেপ না-করলে নরওয়ে সরকার তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে বলে মনে হয় না।” নরওয়ে থেকে ফোনে অনুরূপ বলেন, “আগামী সপ্তাহে এখানকার ভারতীয়দের নিয়ে মৌন মিছিলের করার চেষ্টা করছি।” |
বৃন্দা কারাটের সঙ্গে শিশুদের দাদু-দিদা মনোতোষ ও শিখা চক্রবর্তী। -নিজস্ব চিত্র |
অনুরূপ নরওয়ের স্ট্যাভেনগার শহরে একটি বহুজাতিক সংস্থায় ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে কর্মরত। গত বছর ১১ মে তাঁদের দুই সন্তানকেই নিজেদের কাছে নিয়ে নেয় সে দেশের শিশু সুরক্ষা সংস্থা। সংস্থার মতে, অনুরূপ ও সাগরিকা সন্তানদের ঠিকমতো প্রতিপালন করছেন না। অভিজ্ঞানকে চামচের বদলে হাত দিয়ে খাওয়ানো হতো বা সে তার বাবার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোতো বলে অভিযোগ। দুই শিশুর প্রতিপালন ঠিকমতো হচ্ছে না বলে তাদের পালক-অভিভাবকের কাছে পাঠানো হয়েছে। দুই ভাই-বোনকে আলাদা রাখা হয়েছে। প্রায় আট মাস দুই সন্তানকে ছেড়ে থাকার ফলে নিদারুণ মনোকষ্টে ভুগছেন অনুরূপ-সাগরিকা।
গত বছরের মে মাসে ওই ঘটনার পরেই নরওয়ে ছুটে যান সাগরিকার বাবা-মা। তাঁদের বক্তব্য, দু’দেশের সামাজিক নিয়মে বিস্তর ফারাক থাকায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। ভাষাগত ফারাক থাকায় অভিজ্ঞান সে দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে মেলামেশা করত না। সেই রিপোর্ট পেয়ে শিশু সুরক্ষা সংস্থার কর্মীরা সপ্তাহে একদিন করে বাড়িতে এসে নজরদারি শুরু করে। তার পরেই ওই কর্মীরা রিপোর্ট দেন যে শিশুদের ঠিকমতো পালন হচ্ছে না। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, নরওয়ের মতো ছোট দেশে এমন প্রায় ১৩ হাজার ছেলেমেয়েকে বাবা-মায়ের থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত তাদের বাবা-মায়ের থেকে দূরে রাখা হবে। এই সময়ে ছয় মাসে এক বার, এক ঘণ্টার জন্য শিশুদের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে।
অনুরূপ-সাগরিকা নরওয়েতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। অনুরূপ-সাগরিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ যাতে তুলে নেওয়া হয়, সেই চেষ্টা করছে ভারতীয় দূতাবাস। নরওয়ে প্রশাসন চাইছে, সন্তানদের ঠিকমতো প্রতিপালন হচ্ছে কিনা, বাবা-মা’কে প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু আগামী ৮ মার্চ অনুরূপ-সাগরিকার ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। পরিবারের আশঙ্কা, তার আগে সন্তানদের ফেরত না পেলে বাবা-মা’কে সন্তানদের ছাড়াই বাধ্য হয়ে ভারতে ফিরতে হতে পারে। তা হলে দুই শিশুকে অনাথ বলে ঘোষণা করে সে দেশেই রেখে দেওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। |