একের পর এক চাষির আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড় রাজ্য-রাজনীতি। অভিযোগ, বহু কষ্টে জোগাড় করা ঋণের টাকায় ভাল ফসল ঘরে তুলেও বাজারে ন্যায্য দাম মেলেনি। সংসার চালানো কঠিন হয়েছে। মাথার উপর চেপে বসেছে দেনার দায়। বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাঁরা।
রাজ্য সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, অনেকেই মনে করছেন, এই সমস্যা সমাধানে রাজ্যে কৃষিপণ্য সংরক্ষণে এখনই দরকার বিপুল বিনিয়োগ। প্রয়োজন, ঠিক সময়ে তা বাজারে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত পরিকাঠামোও। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষি-নির্ভর রাজ্যে শুধু এই দুই ক্ষেত্রেই অন্তত ১,১৪০ কোটি টাকা লগ্নি আসা জরুরি।
সম্প্রতি কলকাতায় বেঙ্গল লিডস-এর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে ট্র্যাক্টরস অ্যান্ড ফার্ম ইকুইপমেন্টস-এর প্রধান মল্লিকা শ্রীনিবাসন বলেন, “এ রাজ্যের কৃষকদের সঙ্গে বহু দিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ফসল ভাল হচ্ছে। অভাব রয়েছে ফসল কাটার পরবর্তী পর্যায়ের পরিকাঠামোর। সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা মজবুত না-হলে, শুধু ভাল ফলন নিয়ে লাভ হবে না চাষিদের। তাই পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের এটাই উপযুক্ত সময়।” |
কিন্তু চাষিদের দাম না-পাওয়ার সমস্যা সমাধানে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
অনেক সময়ই দেখা যায়, ফলন ভাল হওয়া সত্ত্বেও লাভের মুখ দেখতে ব্যর্থ হচ্ছেন কৃষক। এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছেন বাজারে তা বিক্রি করতেও। এর মূল কারণ, বাজারের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। তাই কোথাও সেই ফসল নামমাত্র দামে কিনে নিচ্ছেন ফড়েরা। কোথাও আবার ফসল নষ্ট হচ্ছে স্রেফ সংরক্ষণের অভাবে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুলে আনা যায় আলুর পরিসংখ্যানও। ২০১০-’১১ সালে রাজ্যে আলুর ফলন হয়েছে ৯৫ লক্ষ টন। আগের বছরের তুলনায় ১০০ শতাংশ বেশি। অথচ রাজ্যের ৪৮১টি হিমঘরে সংরক্ষণ করা যায় মাত্র ৫৬ লক্ষ টন আলু। অর্থাৎ, স্রেফ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আলু। এবং এই সব ক্ষেত্রেই ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা।
এই বেহাল পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ও। তিনি জানান, বর্তমানে বিক্রির দামের মাত্র ১৫ শতাংশ কৃষকদের হাতে পৌঁছয়। লাভের গুড় খেয়ে যান মধ্যসত্ত্বভোগীরা। তাই রাজ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি কৃষিপণ্য বিক্রি হলেও, শুধু বিভিন্ন মধ্যবর্তী প্রক্রিয়াতেই হারিয়ে যায় অন্তত ৩০ হাজার কোটি। তবে এই ছবি বদলাতে কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় ‘এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি’ (এপিএমসি) আইন শীঘ্রই সংশোধন করা হবে বলে তাঁর দাবি।
কী ভাবে সংরক্ষণ পরিকাঠামো উন্নত করা জরুরি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জন্য প্রতি জেলায় গড়তে হবে সংরক্ষণ ও বিপণন কেন্দ্র। হিমঘর-সহ সম্পূর্ণ সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়তে হবে ‘হাব অ্যান্ড স্পোক’ মডেলে। অর্থাৎ, জেলা সদরে থাকবে মূল কেন্দ্র (যার জন্য লাগবে প্রায় ৩০ কোটি টাকা)। সেই সঙ্গে আরও অন্তত ১০ টি ছোট কেন্দ্র (প্রতিটির জন্য প্রয়োজনীয় লগ্নি ৩ কোটি) গড়তে হবে প্রতি জেলায়। সুতরাং জেলা পিছু বিনিয়োগ লাগবে ৬০ কোটি টাকা। সারা রাজ্যে ১,১৪০ কোটি।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, একা রাজ্যের পক্ষে এই বিপুল লগ্নি করা শক্ত। তাই তাদের নির্ভর করতে হবে বেসরকারি সংস্থাগুলির উপরেও। কিন্তু বাম জমানায় রাজ্যে নিজেদের খুচরো বিপণি চালু করার সময় এ ধরনের পরিকাঠামোয় লগ্নি করে হাত পুড়িয়েছিল মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স রিটেল। রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে থমকে গিয়েছিল তাদের প্রকল্প। এখন মহাকরণে ক্ষমতার রং বদলে গেলেও, কৃষি পণ্যের খুচরো ব্যবসায় বেসরকারি লগ্নির বিষয়ে নতুন সরকারের মনোভাব নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে শিল্পমহলের মনে। বিশেষত বহু ব্র্যান্ডের পণ্যের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস যে ভাবে সুর চড়িয়েছিল, তার পর এ রাজ্যে আরও ভেবে-চিন্তে পা ফেলতে চায় রিলায়্যান্স রিটেল, ফিউচার গোষ্ঠীর মতো খুচরো ব্যবসা সংস্থাগুলি।
এ রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য এই সব সংস্থা যে অনুকূল পরিবেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তা স্পষ্ট ফিউচার গোষ্ঠীর কর্ণধার কিশোর বিয়ানির কথাতেই। তাঁর দাবি, “উৎপাদক ও বাজার দু’য়ের নিরিখেই পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব রয়েছে। তাই লগ্নির উপযুক্ত পরিবেশ পেলে লাভের টানেই এখানে লগ্নি করবে সংস্থাগুলি।”
সুতরাং শিল্পমহলের আস্থা জিতে এই ধরনের পরিকাঠামোয় রাজ্য আগামী দিনে লগ্নি টানতে পারবে কিনা, চাষিদের আত্মহত্যা রোখায় ‘সাফল্য’ অনেকখানি নির্ভর করছে তার উপরেই। |