জন্মেছেন গ্রামে। বিয়েও হয়েছে গ্রামে। থাকেনও গ্রামেই। তাই কাজের ক্ষেত্রে, গ্রামীণ নারী-সমাজে তাঁর কিছুটা বাড়তি সুযোগ হয়েছে বলা যেতে পারে। কিন্তু সব কাজের মূলে যে জেদ এবং সদিচ্ছা তা চল্লিশ ছুঁই নূপুর মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে একশো ভাগ। গ্রামের মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনার যে ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নূপুর তাঁর মুখেই শোনা যাক তার বৃত্তান্ত। “জন্মসূত্রে চিনেছি গ্রাম। গ্রাম নয় অজ-গা। বিয়ে হয়ে জঙ্গিপাড়ার দিলাকাশ গ্রাম থেকে চলে এলাম বউ হয়ে পিয়ারাপুর গাঁয়ে। বিয়ের পরেই থমকে গেল উচ্চমাধ্যমিক। পুত্র লাভ। ক্রমে পুত্রের স্কুল। পড়াশোনা। সেইসঙ্গে নিজের উচ্চমাধ্যমিক পড়া। সংসারের কাজ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম।” শুরু করলেন নূপুর।
তার পর? “সাতাশে উচ্চমাধ্যমিক। তার পর কন্যা সন্তান লাভ। কন্যা মানুষ এবং আবার কলেজের পড়া। তারকেশ্বর কলেজ থেকে সমাজবিদ্যায় স্নাতক। এর পরের পাঠ, নারী সমাজের পাড়ায় পাড়ায়। সে পাঠই আজ আমাকে এখনও চালিয়ে নিয়ে চলেছে।”
এই অঞ্চল দামোদরের বন্যা আক্রান্ত। সে বার ২০০৪ সালের বন্যায় প্রচুর মানুষ ঘর ছেড়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই বন্যার্তদের মধ্যে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে রিলিফের কাজে নূপুরের আত্মবিশ্বাসের প্রসারণ ঘটে। মনের ভিতরে স্বেচ্ছাশ্রমের, সমাজ গড়ার ভাবনার সঙ্গে মিশে যায় দৃঢ় বিশ্বাস। যার ভিত গড়ে দিয়েছিল ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী, স্বামী যোগানন্দের দীক্ষাদান ও আশীর্বাদ। ক্রমে কাজের মধ্যে দিয়েই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গণ বিবাহের উদ্যোগে জড়িয়ে পড়েন।
কিন্তু এর সঙ্গে গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্যবিধির সম্পর্ক? “আসলে এ সব কাজ করতে গিয়েই উপলব্ধি করি মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কতটা জরুরি। তার নিজের এবং সমাজের পক্ষেও। বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের। তখনই ঠিক করি, মহিলাদের সংগঠিত করে গ্রামীণ-নারী জীবনের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে হবে। সরকারি চেষ্টার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চলে ঘরে ঘরে যেমন শৌচাগার গড়ে উঠেছে, তেমনই গ্রামীণ মেয়েদের বয়ঃসন্ধির সমস্যার মোকাবিলা করেছি আমরা।” দম নিতে একটু থামেন নূপুর।
ফের শুরু করেন, “স্কুল কলেজে যাওয়া অধিকাংশ মেয়েরাই এখন সেনেটারি ন্যাপকিনে অভ্যস্ত। যা, এ অঞ্চলে পাঁচ-সাত বছর আগে ভাবনার বাইরে ছিল। দু’টি কারণ। এক অজ্ঞতা, দুই খরচ। কিন্তু এখন চিত্রটা অনেক ভাল।” বললেন নূপুর।
শুরু মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনা গড়ে তোলা নয়, নূপুরদের সংগঠনের সরবরাহ করা স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। যা বিক্রি হয় হাসপাতালে ও ওষুধের দোকানেও। নামী সংস্থার চেয়ে দামে সস্তা হওয়ায় যা গ্রামের মহিলাদের কাছে সহজেই ছড়িয়ে যেতে পেরেছে। “আসলে এর মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ নারীদের রোজগারের পথ খুঁজেছি। পারিবারিক আক্রমণ, বিশেষত বধূ নির্যাতন অনেক মিটিয়েছি। মহিলাদের জীবিকাশ্রয়ী ছোট ছোট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছি।” মুখে সাফল্যের হাসি নূপুরের।
|