মন্ত্রিত্ব থেকে মনোজ চক্রবর্তীর ইস্তফার আর্জি মঞ্জুর করল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বৃহস্পতিবার বিকেলে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর কাছে একটি ‘নোট’ পাঠিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা শাকিল আহমেদ। শুক্রবার শাকিল বলেন, “মনোজ চক্রবর্তী মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। তাঁর আর্জি হাইকম্যান্ড মেনে নিয়েছে।”
হাইকম্যান্ডের অবস্থানে ‘খুশি’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রকাশ্যে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। যেমন মন্তব্য করেননি তৃণমূলের অন্য কোনও মন্ত্রীও। প্রথম কয়েক দিন কটাক্ষ এবং পাল্টা কটাক্ষের পর মমতার নির্দেশেই তৃণমূলের মন্ত্রীরা মনোজবাবুর বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে দলের পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনেও মমতা কার্যত কংগ্রেসের নাম নেননি। যার থেকে তৃণমূল শিবিরের ধারণা, মনোজবাবুকে ইস্তফার অনুমতি দিয়ে হাইকম্যান্ড মমতার সেই ‘সৌজন্যে’রই পাল্টা ‘বার্তা’ দিল যে, তাঁর সঙ্গে ‘সংঘাত’ এড়িয়েই চলতে চাওয়া হচ্ছে।
|
মনোজ চক্রবর্তী |
এখন যে প্রশ্ন নিয়ে জোটে জল্পনা, তা হল মনোজবাবুর বদলে কি কংগ্রেস কাউকে মন্ত্রিত্বে পাঠাবে?
শাকিল বলেন, “বিষয়টি নিয়ে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “প্রণবদার (প্রণব মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” তবে কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, মনোজবাবুর পরিবর্তে মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসের কাউকে আপাতত না-পাঠানোরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকম্যান্ড। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “রাজ্য স্তরে কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই মন্ত্রিসভায় মনোজের পরিবর্তে নতুন মুখ চান না। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত ভাবে কারও তেমন আগ্রহ নেই। কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি ভবিষ্যতে কোন দিকে যায়, তা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” মনোজবাবু যাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত, সেই অধীর চৌধুরী বলেন, “হাইকম্যান্ড দাবি মেনে নেওয়ায় আমরা খুশি। মন্ত্রিত্বের জন্য কংগ্রেসের কোনও নেতা লালায়িত নন। মর্যাদার সঙ্গেই তাঁরা রাজনীতি করতে চান।”
কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্বে কাউকে না-পাঠালে মমতার ‘অখুশি’ হওয়ার কারণ নেই। এ বিষয়ে তিনি অন্তত কংগ্রেসকে কিছু বলতে যাবেন না বলেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “কংগ্রেস মন্ত্রিত্বে কাউকে না-পাঠালে আমরা তৃণমূল থেকে আরও এক জনকে মন্ত্রী করতে পারব।”
খুশি এবং স্বস্তিতে মনোজবাবু নিজেও। হাইকম্যান্ডের সিদ্ধান্ত তাঁকে জানান প্রদীপবাবু। মনোজবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি হাইকম্যান্ডের কাছে কৃতজ্ঞ।’’ তাঁকে না জানিয়ে দফতর ছাঁটার অভিযোগে মহাকরণে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকারকে স্বৈরতন্ত্রী বলেছিলেন মনোজ। প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘পারফরম্যান্স’ নিয়েও। মহাকরণে আর ফিরবেন না বলে বহরমপুরে চলে গিয়েছিলেন।
আজ, শনিবার কলকাতায় এসে প্রদীপবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন মনোজবাবু। কার হাতে ‘পদত্যাগপত্র’ দেবেন, তা নিয়েই আলোচনা করতে চান। বিদায়ী মন্ত্রীর কথায়, “আমার তো পদত্যাগপত্র লেখাই আছে। তারিখটা বসিয়ে পাঠিয়ে দেব।”
মনোজবাবুর ‘ভূমিকা’ নিয়ে অবশ্য কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা আলাদা আলাদা মতাবলম্বী। অধীর-ঘনিষ্ঠ মনোজবাবুর পাশে আগাগোড়াই ছিলেন প্রদীপবাবু। কিন্তু মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই তিনি দলের নেতা তথা মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ারও সমালোচনা করায় বিষয়টি অন্য মাত্রা পায়। মানস-বিরোধীদের একাংশ ইতিমধ্যেই শাকিলের কাছে আবেদন করেছেন, মনোজবাবুকে প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করা হোক। ওই গোষ্ঠীর এক নেতার কথায়, “মনোজ যে ভাবে কংগ্রেসের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করেছে, তাতে দলের কর্মীরা উজ্জীবিত। পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলের কর্মীদের চাঙ্গা করতে মনোজবাবুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া দরকার।”
আর মনোজবাবু বলেন, “দল দায়িত্ব দিলে তা পালন করব। তবে তার আগে অধীরবাবু-প্রণববাবুদের সঙ্গে আলোচনা করে নেব।’’ আপাতত তিনি এক ‘সাধারণ বিধায়ক’ হিসেবেই নিজের কেন্দ্রে কাজ করতে চান। তাঁর কথায়, “বহরমপুরে আমাকে যাঁরা নির্বাচিত করেছিলেন, তাঁদের আমি বোঝাতে পেরেছি, আমি কাজ করতে চাই। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি না।” তৃণমূলের গরিষ্ঠ অংশ অবশ্য মনে করছে, মমতার সঙ্গে ‘সংঘাত’ এড়াতেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড মনোজবাবুকে ইস্তফার অনুমতি দিয়েছে। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের এখন তৃণমূলের সঙ্গে ‘সদ্ভাব’ বজায় রেখে চলা দরকার। পাশাপাশি, রাজ্য চালাতে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারেরও ‘মদত’ দরকার মমতার। মন্ত্রিত্ব থেকে মনোজবাবুর ইস্তফার আবেদন হাইকম্যান্ড মঞ্জুর করায় দুই শরিকের টানাপোড়েনে ‘আপাতত’ ছেদ পড়ল বলেই শাসক-শিবিরের একাংশের অভিমত। |