|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
‘নারী আন্দোলন’ কেবল স্মৃতি? |
স্বাতী ভট্টাচার্য |
মেকিং আ ডিফারেন্স/ মেমোয়ার্স ফ্রম দ্য উইমেন্স মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, রিতু মেনন সম্পাদিত। উইমেন আনলিমিটেড, ৩৫০.০০ |
সে দিন একটা সেমিনারে দেখা হল যশোধরাদির সঙ্গে। যশোধরা বাগচী মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা চর্চা বিভাগের প্রধান ছিলেন অনেকদিন। বুফে লাঞ্চের স্যালাডের শশা দাঁতে কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দিদি, এ রাজ্যে কি এখন নারী আন্দোলন বলে কিছু আছে?’ তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘এখনও তো ‘সচেতনা’ রিসার্চের কাজ করছে কিছু, আর ‘মৈত্রী’রও মিটিং হয় শুনেছি।’ আরও দু-চারটি সংগঠনের কথা উঠল নানা জনের প্লেট-কাঁটার টুংটাঙের মাঝে। শেষে যশোধরাদি যোগ করলেন, ‘তবে আজও যদি বিপজ্জনক হর্মোন ইঞ্জেকশন দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনও চেষ্টা হয়, নিশ্চয়ই আবার সবাই রাস্তায় নামবে।’
সত্যি নামবে কি? ২০১১-র দিকে চেয়ে তা মনে হল না। সাঁতরাগাছির স্বপ্না দে যখন বেআইনি মদের ভাটির বিরুদ্ধে সই-সংগ্রহ করতে নেমে সাংঘাতিক মার খেলেন, কোনও নারী সংগঠন রুখে দাঁড়াল না কেন? ভারতে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই প্রসূতিমৃত্যু বেড়েছে, তা নিয়ে কেন একটা বিবৃতিও পাওয়া গেল না নারীবাদীদের থেকে? গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মডেলে মেয়েদের দারিদ্রমুক্তি হয় না, এই সদ্য-প্রকাশিত তথ্য নিয়ে নারীবাদীরা কোন বিতর্কের সূচনা করলেন?
মনের কষ্টটা এ বার বইয়ের পাতায় খুঁজে পাওয়া গেল। আলোচ্য বইটি সেই সব মেয়েদের বয়ান, যাঁরা আশির দশকে নারী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। কোন তাগিদে তাঁরা এসেছিলেন আন্দোলনে, সেই উদ্দীপনার দিনগুলো কেমন ছিল, ক্রমে কী কী সংশয় দেখা দিল, তা নিয়ে লিখেছেন ইন্দিরা জয়সিং, কমলা ভাসিন, বীণা অগ্রবাল, ইলিনা সেন, নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়, পামেলা ফিলিপোজ-এর মতো জনাকুড়ি মানুষ। আলোকচিত্রী সেবা ছাছি তাঁর তোলা ছবির সঙ্গে লিখছেন ভারতীর মৃত্যুদিনের কথা। ভারতী ছিলেন নারী আন্দোলন এবং বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের সক্রিয় কর্মী। দেহখানি শ্মশানের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ধ্বনি উঠছে ‘লাল সালাম,’ ‘নারী শক্তি জিন্দাবাদ।’ হঠাৎ একজন ধরলেন সেই অতি-পরিচিত গানটি, ‘তোড় তোড়কে বন্ধনোঁকো দেখো বহেনে আতে হ্যায়।’ সেবা লিখছেন, ‘প্রায় ভুলে-যাওয়া এক সত্তা জেগে উঠল যখন আমি গলা মেলালাম - এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করার, বাক্য উচ্চারণ করার উৎসাহ, গাম্ভীর্য, উষ্ণতা আর শক্তি আমার মধ্যে উছলে উঠল। আশি-নব্বই দশকে যা পাওয়া গিয়েছে বলে ধরেই নিয়েছিলাম, ২০১১ সালে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য।’
|
|
|
বাঁ দিকে, শান্তি। ছবি: সেবা ছাছি। ডান দিকে সেবা, শান্তির ক্যামেরায়। |
|
এই যে হারিয়ে যাওয়ার আফশোস, এ কেবল হাতে-হাত রেখে লড়াইয়ের আশা-আশ্বাস খোয়ানোর দুঃখ নয়। মেয়েদের সংকটের মূল চেহারা যে রাজনৈতিক, সেই অতি-কষ্টে লাভ-করা উপলব্ধিটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। যে পরিবর্তনটা মেয়েরা চায় তা কেবল ‘উন্নয়ন’ নামক সর্বসংকটনাশক বটিকা নয়, তা ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল, সে বোধটাও ফিকে হয়ে এসেছে। এখন আমাদের ভাবখানা এমন, যেন সরকার আর একটু টাকা দিলে, সরকারি কর্মীরা আর একটু সক্রিয় হলে, বাপ-শ্বশুর আর একটু ‘সচেতন’ হলে মেয়েদের শিক্ষা, রোজগার, উত্তরাধিকার, সব নিশ্চিত। ফলে মার্চের নারীদিবস থেকে ডিসেম্বরের নির্যাতন-বিরোধী পক্ষ, সবটাই ‘সেলিব্রেশন’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনুদান-সংস্থার থেকে টাকা নাও, পোস্টার-ব্রোশিয়োর ছাপো, সেমিনার-ওয়ার্কশপ করো, হিসেব পাঠাও। বেশ একটা পেশাদারি ব্যাপার। পথ ছেড়ে নারী আন্দোলন গ্যারেজ নিয়েছে এন জি ও-র দফতরে।
আশি-নব্বইয়ের দশকে নারী অধিকারকে মূলস্রোতে আনার জন্য লড়াই করছিলেন যে মেয়েরা, রাষ্ট্রের আর্থিক অনুদানে, আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় তাঁদের আনন্দ পাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু ভয় দেখা দিয়েছে - এই টাকা কি মেয়েদের সক্ষমতার জন্য, নাকি নারী আন্দোলনকে পোষ মানানোর জন্য? নলিনী নায়ক লিখছেন, আর্থিক অনুদান পাওয়ার জন্য ‘জেন্ডার মেলা’ বসে গেল, ‘পুরুষতন্ত্র’ শব্দটাই যেন সরে যেতে লাগল নারীবাদ থেকে। কেরলের মৎস্যজীবী মেয়েদের নিয়ে তাঁর দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে নলিনী লিখছেন, নারীবাদকে রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে আনার চেষ্টা হল না বলে একদিকে যখন রাষ্ট্র মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী, এন জি ও তৈরি করতে লাগল বিপুল সংখ্যায়, অন্য দিকে সেই সময়েই মেয়েরা জল, জমির উপর অধিকার হারাতে লাগল।
মেয়েদের জমির অধিকার, সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নগুলো থেকে সরে আসা নারী আন্দোলনের জীবনীশক্তি হারিয়ে যাওয়ার একটা মস্ত কারণ। মেয়েদের জমির অধিকার কত সামান্য, তা নিয়ে বীণা অগ্রবাল লিখেছিলেন, আ ফিল্ড অব ওয়ানস ওন। নিজের স্মৃতিকথায় লিখছেন, যদিও মেয়েদের ভূসম্পত্তি বা বসতবাড়িতে অধিকার না থাকা তাদের উপর নির্যাতনের একটা বড় কারণ, তবু নারী আন্দোলন জমি-বাড়ির অধিকারের প্রশ্ন থেকে সরে গিয়ে নির্যাতনের প্রশ্নকেই গুরুত্ব দিয়েছে। তবে কি পাশ্চাত্যের নারীবাদ আমাদের বেশি প্রভাবিত করেছে, আমাদের রাজনীতির চাইতে?
রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদের টেনশন তৈরি হয়েছিল বামপন্থীদের সঙ্গে। মেয়েরা পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার তত্ত্বগত উপকরণ বামপন্থীদের থেকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বামপন্থী দলগুলো শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে নারীসংগ্রামকে স্বীকৃতি দিতে অরাজি ছিল, দলের ভিতরের কাজকারবার নিয়ে কোনও প্রশ্ন শুনতেও রাজি ছিল না। সি পি আই এম দলের আলাদা মহিলা শাখা দরকার আছে কি না, তা নিয়েও বহু বিতর্ক হয়েছে পার্টি-সদস্য মেয়েদের মধ্যে। শেষ অবধি ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ শুরু হল ১৯৮৫-তে। কিন্তু তৃণমূল স্তরে মেয়েদের সঙ্গে কাজ করে পাওয়া অভিজ্ঞতা, নীচ থেকে উঠে-আসা বিতর্ক, এগুলোকে দলের সাংগঠনিক স্তরে আনা গেল না। মীরা ভেলায়ুধনের মতো মেয়েরা সন্তর্পণে কাজ চালিয়ে গেলেন - নিজেদের কথা লিখতে লাগলেন দলের প্রচারপত্রে, ‘পজিশন পেপার’-এ। দলের মধ্যে গণতন্ত্র তৈরির কাজটা সহজ হয়নি সে দিন। আজও সহজ নয়।
সম্পাদক রিতু মেনন গোড়াতেই সাবধান করেছেন, এ বই নারী আন্দোলনের ইতিহাস নয়, তার সার্থকতা-ব্যর্থতার খতিয়ান নয়। হয়তো কেতাবি ইতিহাসের দৃষ্টিতে নয় - বেশ ছোট একটি গোষ্ঠীর সদস্যরা লিখেছেন বইতে, প্রায় সকলেই পরস্পর পরিচিত, সহযোগী। সব জনগোষ্ঠী, সব অঞ্চলের মেয়েদের আন্দোলন ধরা পড়েছে, এমন দাবি করা চলে না, করা হয়ওনি। কিন্তু এ বইয়ের পূর্ণতা আসলে অন্যখানে - নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার দায় লেখকদের কারও ছিল না বলে ব্যক্তি-ইতিহাসের সঙ্গে রাষ্ট্র-ইতিহাসের একটা যোগ তৈরি করেছেন তাঁরা। ‘রাজনীতি একটি ব্যক্তিগত বিষয়’ (‘দ্য পার্সোনাল ইজ দ্য পলিটিক্যাল’) নারীবাদের এই মূল স্লোগানটি তাই যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।
সেই রাজনীতি কী করে সরে গেল, কিংবা নারীবাদই সরে এল রাজনীতি থেকে, তার বিবরণ দেওয়া কি ব্যাখ্যা করার দায় স্মৃতিকথার রচয়িতাদের নয়। তবু তাঁদের কথার সূত্র ধরেই নানা প্রশ্ন খোঁচা দিয়ে যায়। সত্যিই তো, মেধা পটেকর বা অরুণা রায়ের মতো নেতারা যে নিজেরা মেয়ে, তা-ই তো কেবল নয়। তাঁদের জন-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অধিকাংশই মেয়ে। অথচ তাঁরা নিজেদের নারীবাদী বলেন না, তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে নারী আন্দোলনের কোনও যোগসূত্রও স্পষ্ট করেননি। কেন এমন হচ্ছে?
প্রশ্নটা করা গেল মালবিকা কার্লেকরকে (আবারও সেমিনারে!)। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব জেন্ডার স্টাডিজ’-এর সম্পাদক মালবিকাদি বললেন, ‘ভালই তো, মেয়েদের কথা কেবল নারীবাদীরাই বলবে কেন? যে কোনও অবস্থান থেকেই মেয়েদের কথা উঠে আসা দরকার।’
কিন্তু আশির দশকের নারীবাদীরা তো বলেছিলেন, ‘নারীবাদী অবস্থান’ বলে আলাদা কিছু নেই। যে কোনও আন্দোলনই নারীবাদের, যদি তা হয় মর্যাদার লড়াই, সমানাধিকারের লড়াই। আজ কী করে নারীবাদের হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল তথ্যের অধিকার আন্দোলন, খাদ্যের অধিকার আন্দোলন কিংবা দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন থেকে? তবে কি যে কোনও আন্দোলনের মতোই, নারী আন্দোলনেও নেতারা বড় হয়ে উঠলেন নীতির চাইতে? এটা আমার লড়াই, ওটা তোমার, এমন করে জমিদারি ভাগ হতে হতে শেষে পায়ের তলার মাটিটুকু সরে গেল আম-মহিলার?
যাঁরা স্মৃতিচারণ করেছেন এই বইতে, তাঁরাও কেউ কেউ তা হলে নারী আন্দোলনকে ‘স্মৃতি’ করে ফেলার দায়ের ভাগিদার। |
|
|
|
|
|