|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১... |
পিকনিক |
সামনের সপ্তাহে দু’টো ছুটি। তা ছাড়া রোববারটা তো আছেই। বেড়াতে যাবার সময় নেই?
এক বেলার জন্য রুটিন তো ভাঙা যেতেই পারে। তা হলে হয়ে যাক...
লিখছেন শিলু চট্টোপাধ্যায় |
পিকনিকের বাংলা-বনভোজন। পিকনিকের দুটো বাহ্যিক গুরুত্বপূর্ণ দিকই শব্দটাতে ধরা আছে। পিকনিক হয় কোনও বনে— মানে বাড়ির বাইরে কোনও মনোরম জায়গায়। আর এই মনোরম জায়গা উপভোগ করার জন্য চাই এক মনোরম আবহাওয়া। তাই গ্রীষ্ম, বর্ষা বাদ দিয়ে বেশির ভাগ পিকনিক হয় ঠান্ডার সময়। আর ভোজন তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সকালে বাড়ির শুকনো পাউরুটির বদলে লুচি-আলু ছেঁচকি আর দুপুরে ডাঁটা চচ্চড়ির বদলে মাংস ভাত।
অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে আসলে কিন্তু পিকনিকের খাওয়াদাওয়াটা তেমন কিছু হয় না। বিয়েবাড়ির ঢঙে কমই শোনা যায়-ওঃ সেই নূরপুরের পোলাওটা এখনও মুখে লেগে আছে। এমনিতে পিকনিকে লুচিগুলো কাটার জন্য কাঁচি ছুরি হলে সুবিধে হয়। আর ক্রমাগত “ঠাকুর আর কত দেরি?”র অবশ্যম্ভাবী ফল দুপুরের মাংস আধসেদ্ধ। তার ওপর পিকনিকে গিয়ে জলখাবারের সঙ্গে ভাতমাংসের দূরত্বটা অনেকেরই একটু বাড়াবাড়ি লাগে। আর সাধারণত পিকনিকের জায়গাগুলো এমন বাছা হয় যে চট করে বেরিয়ে একটু চপ কাটলেট বা নিদেনপক্ষে ঘুগনি পাউরুটি খাবেন তার উপায় নেই। বাড়ি থেকে বিস্কুট? দেখতে একটু খারাপ লাগে। পিকনিকে সবাই মিলে সব কিছু-- না হলে একটু তাল কেটে যেতে পারে।
এর ওপর যাওয়ার জন্য যে বাসটা নেওয়া হয় তার গদিটা কবেই সাইজ জিরো হয়ে গেছে। ওই বাসে রাসবিহারী থেকে এলগিন যেতে অতটা জানান দেয় না। কিন্তু সাড়ে তিন ঘণ্টার পিকনিক স্পট অবধি যেতে বেশ কষ্ট হয়। এমনিতেই ভোরে ওঠা অভ্যেস না থাকলে গায়ে জ্বর আসে। তাই পিকনিক ধাতে সয় না এমন মানুষ কিন্তু কম নেই। তবে তাঁরাও একবার পিকনিকের জায়গায় গিয়ে পড়লে উপভোগ করেন। কারণ পিকনিকটা আসলে বনভোজন নয়- মন ভোজন।
পিকনিকের আনন্দ আসলে দাঁড়িয়ে থাকে অন্য দুই স্তম্ভের ওপর। পিকনিক দৈনন্দিনতা থেকে ছুটি দিয়ে দেয়। হেঁসেল ঠেলা বা বাজার করা নেই, অঙ্কের হোম ওয়ার্ক বা গানের মাস্টারমশাইয়ের কথা একদিন অন্তত চেতনার বাইরে রাখা যায়। রুটিন ভাঙার এ আনন্দ তাই নিঃসন্দেহে অপরিসীম। এটাই পিকনিকের প্রথম বড় পাওয়া। নদীর পাড়টা, বাগানের ফুলগাছগুলো বা পুকুরধারের গাছতলাটা আসল নয়— তারা বড়জোর বনভোজনের এই ঘণ্টামাপা স্বাধীনতাটাকে উপভোগ করতে সাহায্য করে।
আর দ্বিতীয় আনন্দটা হল পিকনিক ব্যক্তিকে সমষ্টিতে নিয়ে যায়। আর সমষ্টি অনেক সময়ই ব্যক্তির মুখোশটা খুলে মুখটা সামনে নিয়ে আসে। জগৎবাবু অঙ্কের দুঁদে মাস্টারমশায়। হোমটাস্ক না করলে স্কেলের বাড়ি, বোকার মতো প্রশ্ন করলে প্রচণ্ড বকুনি। এ হেন জগৎবাবু ক্লাস টেনের ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেটে নামলেন। বল পড়ল পাশের বাড়ির বাগানে। ধুতি মালকোচা মেরে জগৎবাবু মুহূর্তের মধ্যে গাছ বেয়ে পাঁচিল টপকে বল নিয়ে নিলেন। পিকনিকে না গেলে কেউ এই জগৎবাবুকে দেখতেই পেত না। এক অর্থে এও এক রোজকার থেকে শাপমুক্তি।
|
|
জগৎবাবুর গাছে চড়ার অন্য প্রান্তে আছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সাময়িক হলেও কয়েকজন মানুষ কাছাকাছি আসেন। কোনও না কোনও ফর্মে মেমারি গেম খেলা চলে। কাবেরী বসুর রবীন্দ্রনাথ, শুভেন্দুর কার্ল মার্কস, শর্মিলার ক্লিওপেট্রা, রবি ঘোষের অতুল্য ঘোষ আর শমিত ভঞ্জের হেলেন হয়ে সৌমিত্রর ইম্প্রেস করার চেষ্টা নিয়ে বলা শেক্সপিয়র। শর্মিলার স্বেচ্ছায় হার মানার পর জাম্পকাটে নাগরদোলার একা দোলায় সৌমিত্র শর্মিলা। কিংবা অন্য দৃশ্যকল্পে পিকনিকে কেউ একজন গান ধরেছেআমার হৃদয় নিয়ে আর কতকাল বলো কাছে এসে দূরে দূরে থাকবে। দুই সহপাঠী-পর্দার নয় জীবনের।
সৌমিত্র শর্মিলা একটু আলাদা হাঁটছে। সাহস করে সৌমিত্র এই শর্মিলাকে ফিসফিস করে বলেই ফেলল- গানের প্রশ্নটার কোনও উত্তর আছে?
গত শতাব্দীর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির মতো লাগছে? আজকের পিকনিকে কি এ সব হয়? বাহ্যিক ভাবে অনেক কিছু নিশ্চয়ই বদলেছে। আজকের কোনও বড়দিনে বা নববর্ষে ফলতা কিংবা ত্রিবেণীর গঙ্গার ধারের ছবিটা একটু অন্যরকম। সে রকম কুয়াশা হয়তো নেই। ওপারে গ্রাম-গঞ্জ। গঙ্গার ওপর নৌকো, একটা ধোঁয়া ছড়ানো স্টিমার। এ সব দেখে শেষ করে চোখ নামাতেই দেখবেন সামনের রাস্তায় পিকনিকাররা বাস থেকে মাল নামাচ্ছেন। বড় বড় ডেকচি, হাঁড়ি, হাতা, খুন্তি। দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটা শতরঞ্চি উঠলো ভ্যানে। তারপর নামল এমন দু’টো জিনিস যেটা নতুন। একটা কালি-ঝুলি মাখা জেনারেটর আর তার অভিন্নহৃদয় সঙ্গী ডিজেলের টিন। ভাববেন এরা কি ইলেকট্রিকে রান্না করবে না সন্ধেবেলা অবধি থাকবে তাই আলো জ্বালাবে? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন। না, রান্নাও নয়, সন্ধেও নয়জেনারেটরের আসল দায়িত্ব ঢাউস সাইজের চারটি বিরাট স্পিকার থেকে শ্রেয়া কিংবা সোনু, কোলাভেরি অথবা আশাবরী বের করানোর।
এক পিচ রাস্তায় মাল নামানো চলছে। সেই রাস্তাতেই কলকাতা যাবার বাস স্ট্যান্ড, এদিক ওদিক গাড়ি রাখা। গঙ্গার পাড় বলে তেমন কিছু নেই। তাই পিকনিক করতে যেতে হবে একটু দূরে যেখানে নদীর ধারে একটু মাঠ মতো আছে। শীতের রোজ রোববার এখানে কলকাতার অটো স্ট্যান্ডের মতো সাইকেল ভ্যানের স্ট্যান্ড লেগে যায়। সার সার সাইকেল ভ্যান থাকে ওদেরই অপেক্ষায়। পিকনিকের বাসেদের এখানেই প্রথম স্টপ। পিকনিকের দল এসে নামে। সম্বোধনে ঠাহর হয় কেউ কেউ অফিস থেকে এসেছেন“ব্যানার্জিদা চানাচুরটা নামাবেন কিন্তু....”। আবার কেউ পাড়ার ক্লাব থেকে এসেছে, নবারুণ সঙ্ঘের স্যাটিনের ব্যানারটা ট্রাকের গায়ে ল্যাপ্টানো। দু’ দলেই ছেলে-মেয়ে মেশানো। লোকজনদের মধ্যে সামান্য তফাত থাকলেও মালপত্রে এরা সবাই সমান। হাতা-খুন্তি থেকে ঢাউস স্পিকারসবারই সঙ্গী।
গ্রামের ভিতর দিকে কিছুটা হাঁটলেই চোখে পড়বে মাঠ। আসলে মাঠ নয়, খেত। বোঝা যায় এখানে নিয়মিত চাষ হয়। কিন্তু পিকনিকের দিনগুলোতে ওটা ফ্রি পার্কিং জোন। টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে এক স্থানীয় যুবক। সামনে স্লিপ প্যাড। ছেলেটির চোখে মুখে দেখবেন এক দিনের জন্য এমএলএ হবার অভিব্যক্তি। তার মনসবদারিতে ওই সব দিন থাকে অন্তত খান পঞ্চাশেক বাস আর লরিওই খেতে পার্কিং করা।
নদীর পাড়ের সেই মাঠে যেখানে সর্বজনীন পিকনিক চলছে সেখানে গেলে দেখবেন অনেক পুরনো ছবি। কোথাও চা দেওয়া হয়েছে। আয়োজকদের একজন ঘুরে ঘুরে ঠোঙা থেকে সবাইকে বিস্কুট দিচ্ছে। আর এক দল কাঠের উনুন ধরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। যে রকম হয়আগুনের থেকে ধোঁয়া বেশি বেরোচ্ছে। ওঁদের বোধহয় নিজেদের রান্না করার অভিপ্রায়। আবার অন্য দু’এক জায়গায় পুরোদস্তুর উর্দিপরা ক্যাটারারের বেয়ারাদেরও দেখা যাবে। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, অন্ত্যাক্ষরী, তাস আর শুয়ে বসে আড্ডামেনু আগের মতোই। নতুন বলতেমোবাইল বিনোদন। পাশের গাছ, দূরের নদী, ভুলে মন দিয়ে মোবাইলে ‘অ্যাংরি বার্ডস’। ফুটবলটা নেই, রুমালচোরকেও দেখতে পাবেন না। আর নেই খালি গলার গান। বদলে বাজনা বা গানের তালে উদ্দাম নাচ পেয়ে যেতে পারেন। আর দেখবেন মাঝ শীতে, ভাটার টানে বয়ে যাওয়া নৌকো। মাঝি আপন মনে বৈঠা বাইছে। আর ছই-এর ছায়ায় বসে সিলোয়েটে দু’জন। চেনা মহলের বোরখা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। ভাববেন যাক, হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াটা আছে তা হলে। ঘোর কেটে যাবে শব্দের জগঝম্পে। আপনি ভাবতে থাকবেন চল্লিশটা স্পিকারে আটজনের গলায় দশটা গানের সিম্ফনিটাতে লোকে বিরক্ত হন না? ভালো করে লক্ষ করলে বুঝবেন যে আর সব কিছুর মতোই ওই সিম্ফনিটারও কাজ একটাই।
আসলে পুরো পিকনিকটাই একটা ঘোমটা যা দিয়ে সবাই রোজকার চেনা রোদ্দুরটা থেকে নিজেদের আড়াল করেন। |
|
|
|
|
|