ব্যাগ গুছিয়ে...
স্বপ্নসুন্দরীর কাছে
গের রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরেছি ক্যামেরা আর হেডল্যাম্প নিয়ে আমার ছোট্ট সোনা ব্যাঙ রাজপুত্তুরের খোঁজে। হোটেলে ফিরে আসার পর প্যান্টের পা গুটিয়ে জোঁক ছাড়িয়েছি, জঙ্গল চিরে নেমে আসা জলে স্যালামান্ডারদের সাঁতার কাটতে দেখেছি। অন্ধকার মোড়া ‘নিডল পাইন’-এর বনে এখন নেই কোনও দাপুটে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। এ অন্ধকার শুধু আমি-ময়। চাঁদ উঁকি দিয়েছিল আকাশে তার চন্দ্রকলা নিয়ে, আলো ফেলেছিল পাইনের জঙ্গলে আর জঙ্গল ছুঁয়ে থাকা লেকের জলে। পাইনের গা জুড়ে গড়িয়ে আসা অজস্র জলের ফোঁটা লাজুক হেসেছিল। লেকের জলে থাকা মাছেরা ঘুমোতে যাওয়ার আগে দেখেছিল সেই হাসি। তার পর? আর ঘুমোতেই পারেনি, সারারাত ঠায় দাঁড়িয়েছিল শান্ত হয়ে অবাক দু’চোখ মেলে।
শহর শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ছুটছে গাড়ি গাড়িধুরা সীমানা হয়ে। দু’পাশে শুধু সবুজ আর সবুজ, পাহাড়ের পর পাহাড় জুড়ে...যেন সবুজ গালচে পাতা। এ পথে অজস্র চা-বাগান। যদি নিজের গাড়িতে আসেন, হঠাৎ করে আসা পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে যান একটু। নরম শীতের আমেজ গায়ে মেখে চোখ মেলে দিন দূরে। তার পর আবারও চলা। একটু ভেজা-ভেজা ভাব বাতাসে, গাছেদের গায়ের গন্ধ, লম্বা পাইনটার আড়ালে হঠাৎ নজরে আসা সাদা জমিতে লাল বুটির বুনো অর্কিড... কী যে ভালবেসে ফেলবেন তাকে! এমন করেই অনেক ভালবাসায় ভাসাতে ভাসাতে পাইনের জঙ্গল ভেদ করে গাড়ি আপনাকে নিয়ে আসবে সমুদ্র-সমতল থেকে ১৪০৮ মিটার উচ্চতায় ছোট্ট শান্ত এক সুন্দরীর কাছে শৈলশহর মিরিক।
হোটেলে ‘চেক ইন’ করিয়ে সোজা চলে যাই মিরিকের প্রধান আকর্ষণ সুমেঙ্গু হ্রদের ধারে। এই লেকই মিরিকের প্রাণ। এক জায়গায় দেখি অনেক লোক ভিড় করেছে। ছোট ছোট করে ছেঁড়া পাউরুটির টুকরো, মুড়ি, এই সব ফেলছে জলের ওপর আর মাছেরা কপকপ করে সেগুলো খাচ্ছে। তাদের হুটোপাটিতে জল ভাঙছে শান্ত হ্রদে। একটা পাউরুটি কিনে টুকরো করে ছড়িয়ে দিই জলে। মাছেদের আনন্দে শামিল হই। একটু পরে এগিয়ে যাই সামনের দিকে। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি লেকের জলে ভিড় করেছে প্লাস্টিক আর আবর্জনার দল।
কোনও তাড়াহুড়ো নেই, পায়ে পায়ে মাঠ পেরিয়ে ডানহাতি দোকানগুলো রেখে এগোই লেকের অন্য পাশে, ব্রিজের ওপর। ট্যুরিস্ট এখন কম। ছুটে আসা ছেলেটাকে আশ্বাস দিই কাল বোটে চাপব, আজ তো সবে এলাম। ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র একটি আমার পাশ কাটিয়ে দৃপ্ত পায়ে ব্রিজ পেরিয়ে পশ্চিমে পাইনের ছায়াপথে ঢুকে যায় সহিসকে নিয়ে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলতে থাকি। প্রথমে দুর্গামন্দির, তার পর রামিতেদাঁড়া বা দেওমিদাঁড়ায় পৌঁছে সামনে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। ফেরার পথে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মন ভাল করে দেওয়া হাসি উপরি পাওনা। নামছি যখন তখন সন্ধ্যাও নামছে। সাদা সাদা মেঘগুলো কেমন লেকের জল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমি যখন পাইনবনের শেষ ‘ল্যাপ’টায়, তখন আমাকে হারিয়ে দিয়ে কুয়াশা পৌঁছে গেল লেকের পাশে। পাইনগাছগুলো কেমন আবছায়া হয়ে গেল, লেকটাও। মাঠের ওপর দুটো পায়রা পায়চারি করছে। ওপারের দোকানগুলোয় আলো জ্বলছে। দোকানগুলোর মাঝে থাকা পাকা রাস্তা ধরে পৌঁছে যাই প্রায় আমার আস্তানার কাছে। রাস্তায় এক দিদির ভ্রাম্যমাণ ‘মোমো শপ’-এ বসি। গরম গরম এক প্লেট স্টিমড মোমো আর এক কাপ চা...আহা! একেই তো বলে স্বর্গ।
পরদিন সক্কালবেলা, তখনও মিরিকের ঘুম ভাঙেনি, হোটেলে আমার দরজা খুলে বারান্দায় এসে অবাক! কে যেন এক সাতনরী হার বিছিয়ে রেখে গেছে আমার জন্য। ভাল করে নজর করে দেখি, একটা মাকড়সা জাল বুনেছে, তার বোনা জালে রাতের শিশির একটা একটা করে বিন্দু হয়ে লেগে আছে। ভোরের আলোয় ওই বিন্দুরাই অমন ঝকমক করছে, ঠিক যেন হিরের কুচি। এই সাতনরী হারই কি পৃথিবীর প্রথম ভালবাসায় আদম ইভকে পরিয়ে দিয়েছিল? ভাবতে ভাবতে একটা আঙুল ঠেকাতেই এককুচি হিরে আমার আঙুলে। পা বাড়াই মিরিকের মনেস্ট্রিতে। মনেস্ট্রি থেকে নীচে মিরিককে দেখতে বড় সুন্দর। ঘুরে এসে যাব সুখিয়াপোখরি হয়ে পশুপতি মার্কেট। দুপুরে হোটেলে ফিরে খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে পাইনের জঙ্গলে নরম রোদ-ছায়ায় ঘুরব। তার পর পড়ন্ত বিকালে একটা রঙিন বোট নিয়ে ভেসে যাব লেকের জলে। ঠান্ডা হাওয়ায় যখন শরীরে একটা শিরশিরানি ভাব আসবে তখনই নৌকা বাঁধব কূলে।
এক পশলা বৃষ্টি যখন রাতের মিরিকে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছে তখন আড়াই সেন্টিমিটার মাপের আমার ব্যাঙ রাজপুত্তুর ডাকছে তার সঙ্গিনীকে। মিরিকের অন্ধকার ভেঙে লেকের জলে দোলা দিচ্ছে সেই ডাক...আচ্ছন্ন করছে আমাকে। সাদা মেঘেরা পাখিদের সঙ্গী করে ছুঁয়ে যাচ্ছে লেকের জল...মহিনের ঘোড়ারা ছুটে চলেছে ছায়াপথ ধরে। তিনটি বাচ্চা সুন্দর হাসি নিয়ে কুয়াশায় ঘেরা পাইনের বন থেকে বেরিয়ে আসছে, যেন কুয়াশার দেবদূত! আমার স্বপ্নসুন্দরী মিরিক সাক্ষী রইল তার।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেন অথবা বাসে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে বাস,
গাড়ি অথবা শেয়ার জিপে মিরিক। দার্জিলিং থেকেও আসা যায়।
কখন যাবেন
সব থেকে ভাল সময় শীতকাল। বর্ষায় অন্য রূপ, তবে রাস্তার কথা ভেবে যাবেন।
সাধারণত গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ২৯-৩০ ডিগ্রি আর শীতে তাপমাত্রা ৯-১০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে।
কোথায় থাকবেন
সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নানা মানের অনেক হোটেল ও লজ আছে মিরিকে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.