উন্নয়নের পথে
সরবে কাঁটা
থের কাঁটা! এত দিন এই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট। সিটি পুলিশ ও পুরসভার সাম্প্রতিক বৈঠকে সেই কাঁটা সরার আশা দেখা দিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে হাওড়া শহরাঞ্চলে পুলিশ কমিশনারেট চালু হয়েছে। কার্যত ওই মাস থেকেই সূচনা হয়েছে হাওড়াকে মেগাসিটির রূপ দেওয়ার সরকারি চেষ্টা। আগে যেখানে গোটা জেলার পুলিশি ব্যবস্থা ২-৩ জন আইপিএস অফিসার নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন সেখানে শহরের ৮টি থানার জন্য রয়েছেন ৭ জন আইপিএস অফিসার। পাশাপাশি, গড়ে তোলা হচ্ছে কমিশনারেটের উপযোগী পরিকাঠামো, যদিও এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে। এর মধ্যেই শহর পেয়েছে ১০০ ডায়ালের সুবিধা, রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী, ডগ স্কোয়াড ইত্যাদি। তৈরি হতে চলেছে কমিশনারেটের নিজস্ব বম্ব ডিস্পোজাল স্কোয়াড। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সিআইডি-র সঙ্গে হাওড়া সিটি পুলিশ কর্তাদের এক দফা বৈঠকও হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কমিশনারেট হওয়ার পরে শহরের সামগ্রিক পরিস্থিতি কতটা পাল্টেছে?
বাসিন্দারা জানান, গত চার মাসে হাওড়ার ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। যানজট কমেছে। গতি বেড়েছে যানবাহনের। পুলিশ সূত্রে খবর, বাসিন্দাদের ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা হয়েছে। জরিমানা বাবদ তিন মাসে ৭০ লক্ষ টাকা আদায় হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই উন্নয়নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওড়া পুরসভার পরিষেবা সংক্রান্ত কিছু বিষয়। সিটি পুলিশের দাবি, এই সমস্যাগুলিই শহরের সার্বিক উন্নয়ন ও পুলিশের প্রশাসনিক কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কী সেই সমস্যা?
পুলিশের মতে, এক) শহরের অধিকাংশ অলি-গলি, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। ভয়াবহ অবস্থা হাওড়া-আমতা রোডের। দুই) শহরে নির্দিষ্ট কোনও পাকির্ং-এর ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র পার্কিং করা হয়। তিন) শহরের যত্রতত্র রাস্তার পাশে ভ্যাট। এ জন্য অনেক রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে। চার) আবর্জনা পরিষ্কারের নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই পুরসভার। অফিসের সময়ে ভ্যাট পরিষ্কারের জন্য পুরসভার গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে যানজট নিত্য ঘটনা। পাঁচ) রাস্তা দখল করে বসা হকাররাজ এবং শহর জুড়ে চলা বেআইনি রিকশা।
পুলিশ ও পুরসভার সমন্বয় ছাড়া যে শহরের কোনও উন্নতি সম্ভব নয় তা মানছেন হাওড়া পুরকর্তৃপক্ষ। সমাধানের জন্য সম্প্রতি পুরসভার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে। প্রস্তাব পাওয়ার পরেই গত ১৭ জানুয়ারি মেয়র মমতা জয়সোয়াল তাঁর ঘরে সিটি পুলিশের কর্তাদের বৈঠকে ডাকেন। উপস্থিত ছিলেন পুলিশ কমিশনার এবং ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (সদর) সুকেশ কুমার জৈন। পুরসভার পক্ষে মেয়র ছাড়াও ছিলেন মেয়র পারিষদ (জল ও লাইসেন্স ) সমীর সাহা, মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল ও তথ্য সংস্কৃতি) দেবাশিস ঘোষ-সহ পুরসভার উচ্চপদস্থ অফিসারেরা।
ওই বৈঠকে শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু পার্কিং জোন গড়ার প্রস্তাব পুরসভাকে দেয় পুলিশ। সিটি পুলিশের মতে, এতে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধ করা যাবে। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে পুরসভার কাছে পার্কিং জোন গড়ার জন্য কয়েকটি জায়গার নাম জানতে চাওয়া হয়েছে। ওই তালিকা পাওয়ার পরে পুলিশ জায়গাগুলি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে বলে জানা গিয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, শহরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার অবৈধ রিকশা চলছে। এই ধীরগতির যানের কারণে অন্য যানের গতিও কমে গিয়েছে। যানজট হচ্ছে। এই অভিযোগ মেয়রও মেনে নিয়েছেন। পুরসভার হিসেবে শহরে লাইসেন্স নিয়ে রিকশা চলে প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু পুরসভা জানায়, অবৈধ রিকশা ধরার পরে সেগুলি রাখার জায়গার অভাব রয়েছে। সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “পুরসভা এবং আমরা অবৈধ রিকশা ধরে সেগুলি রাখার জায়গা খুঁজছি। পেলেই তল্লাশি শুরু হবে।”
এই বৈঠকেই স্থির হয়, এখন থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরসভার ময়লা ফেলার গাড়ি আবর্জনা তুলবে। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে এবং বেলা সাড়ে ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ময়লা তোলার কাজ হবে। বিকাল ৫টার পরে যাতে পথে কোনও ময়লার গাড়ি না থাকে সে জন্য ঠিকাদার সংস্থাগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে সব জায়গায় ভ্যাট রাস্তার মধ্যে এগিয়ে এসেছে পুলিশের পক্ষ থেকে তা সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। পুলিশের দাবি, ভ্যাটের জন্য ওই সব জায়গায় যানজট হচ্ছে। মেয়র বলেন, “নতুন করে ভ্যাট করার অনেক সমস্যা রয়েছে। বাড়ির সামনে ভ্যাট করলে বাড়িওয়ালারা আপত্তি করছেন। তাই পুলিশকে দায়িত্ব দিয়েছি জায়গা খুঁজে ভ্যাট তৈরির একটি তালিকা করতে। সেই তালিকা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
অবিলম্বে মাছবাজারে জমে থাকা পাহাড়প্রমাণ থার্মোকল সরিয়ে ফেলতে পুরসভার কাছে পুলিশ আবেদন করে। না হলে ফের বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে পুলিশ আশঙ্কা প্রকাশ করে। পাশাপাশি পুলিশের প্রস্তাব, দুরপাল্লার প্রধান বাসস্ট্যান্ড হাওড়া স্টেশন থেকে সরিয়ে টিকিয়াপাড়ায় করা হোক। পুলিশের দাবি, এতে হাওড়া স্টেশন চত্বর যানজট মুক্ত হবে। একই সঙ্গে পুলিশ কমিশনার মেয়রের কাছে প্রস্তাব দেন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ভাঙা পাঁচিল সারিয়ে অবিলম্বে আলোর ব্যবস্থা করতে। মেয়র ওই প্রস্তাবে সায় দিয়ে জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৈঠকের পরে মেয়র বলেন, “শহরের উন্নতির জন্য আমরা পুলিশকে সব দিক থেকে সাহায্য করব বলে জানিয়েছি। পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব এসেছে। কিছু সিদ্ধান্ত সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ব্যাপারে দায়িত্ব সিটি পুলিশ নিয়েছে।” হাওড়ার ডিসি (সদর) সুকেশ জৈন বলেন, “পুরসভা উদ্যোগী না হলে সব সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। সমস্যা না মিটলে রাস্তা যানজটমুক্ত হবে না। আইনশৃঙ্খলারও সার্বিক উন্নতি হবে না। পুরসভা এগিয়ে আসায় সমস্যা মিটে যাবে বলে মনে হচ্ছে।”

ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.