|
|
|
|
বর্ধমানে মৃত্যুমিছিল |
চাষির বাড়ির সদ্যযুবক আত্মঘাতী কেতুগ্রামে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কেতুগ্রাম ও কলকাতা |
চাষে বিপর্যয়ের জেরে রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বর্ধমান জেলায় মৃত্যুমিছিল অব্যাহত।
শুক্রবার কেতুগ্রামে নিরোল গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় প্রসেনজিৎ মণ্ডল (২০) নামে চাষি পরিবারের এক সদ্যযুবকের দেহ মেলে। পরিবারের অভিযোগ, বোরো চাষের জন্য মোষ কেনার টাকা জোগাড় না হওয়াতেই তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন।
চাষে মার খেয়ে, ঋণের জালে জড়িয়ে বর্ধমানে ইতিমধ্যে অন্তত ১০ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন বলে অভিযোগ। শুধু গত এক সপ্তাহেই রাজ্যে ছয় চাষির আত্মহত্যার ‘খবর’ মেলে। তার মধ্যে চার জন
বর্ধমানের। বৃহস্পতিবার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্যে অন্তত ২৩ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন।
কেতুগ্রামের প্রসেনজিৎ সেই তালিকায় নবতম সংযোজন। |
|
প্রসেনজিৎ মণ্ডল |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বারবার রাজ্যে চাষের সঙ্গে যুক্ত কারও আত্মহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন। একটি ক্ষেত্রেও আত্মহত্যার সঙ্গে চাষের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেনি রাজ্য প্রশাসন। এ দিনও কাটোয়ার মহকুমাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম বলেন, “কেতুগ্রামের ওই পরিবারের মোষ দু’টি চাষের জন্য নয়, পরিবহণের কাজে ব্যবহার হত বলে রিপোর্ট পেয়েছি।” কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ বলেন, “সব জায়গায় সহায়ক মূল্যে ধান
কেনা হয়ে গিয়েছে, এমন দাবি করছি না। কিন্তু এই যুবকের আত্মঘাতী হওয়ার পিছনে চাষ সংক্রান্ত কোনও ব্যাপার নেই।”
প্রসেনজিতের পরিবার সূত্রে অবশ্য জানা যায়, তাঁর বাবা রামপ্রসাদ মণ্ডলের আড়াই বিঘে জমি রয়েছে। চাষ ছাড়াও বেশ কয়েক বছর আগে ঋণ করে কেনা সাবমার্সিবল পাম্পের জল এলাকার চাষিদের কাছে বিক্রি করে তাঁদের সংসার চলে। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। দারিদ্রের কারণে বড় ছেলে বিশ্বজিৎ কয়েক মাস আগে কর্ণাটকে নির্মাণকর্মীর কাজ করতে গিয়েছেন। ছোট ছেলে প্রসেনজিৎ তৃতীয় শ্রেণির পরে পড়াশোনা ছেড়ে চাষের কাজে লেগে পড়েছিলেন।
রামপ্রসাদবাবু বলেন, “কয়েক দিন আগে বোরো চাষের জন্য জমিতে হাল দেয় ছোট ছেলে। সেই থেকেই বলছিল, একটা মোষ অসুস্থ। সেটা বেচে নতুন মোষ না কিনলে আর চাষ করা সম্ভব নয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমি জানিয়ে দিই, নতুন মোষ কেনার টাকা আমার কাছে নেই। একে ব্যাঙ্কের ঋণ রয়েছে, তার উপরে জল বিক্রির সব টাকাও পাওয়া যায়নি। এ কথা শুনে ও বাড়ি থেকে চলে যায়।” |
|
প্রসেনজিতের ছবি হাতে শোকার্ত পরিবার। কেতুগ্রামের নিরোল গ্রামে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় |
নিরোল গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় কোনও ক্রমে মাথা গোঁজার মতো মাটির বাড়ি। সেখানেই ছোট ধানের গোলা, একটি গরু ও দু’টি মোষ নিয়ে বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারের বাস। মৃতের মা ভগবতী মণ্ডল বলেন, “খরিফ চাষ করে ৩৫ বস্তা ধান (৬০ কেজির) পেয়েছিলাম। ফড়েদের কাছে ৪৬০ টাকা দরে (সরকারি দর ৬৪৮ টাকা) মাত্র ৮ বস্তা বিক্রি করতে পেরেছি।” তাঁদের প্রতিবেশী শিশিরকুমার পাত্র, গদাধর পাত্র, নারায়ণচন্দ্র রানোদেরও খেদ, “সরকারি দাম পাওয়া দূরের কথা, ফড়েরাও ধান কিনছে না।”
মৃতের বাবার দাবি, গত বছর আলু চাষের জন্য তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় তা শোধ করতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ, “একটা পুরনো মোষ পাল্টে নতুন কিনতে অন্তত ৮ হাজার টাকা দরকার। ভেবেছিলাম, ধান ও জল বিক্রির টাকায় বোরো চাষের আগে তা করতে পারব। কিন্তু বিপর্যয় তো সব দিকে। টাকাই পেলাম না।”
গ্রামের মথুরা মণ্ডল, জগন্নাথ মণ্ডলেরা মেনে নেন, “ওদের থেকে চাষের জল কিনেছিলাম। কিন্তু ধান বিক্রি না হওয়ায় দাম দিতে পারিনি।” পড়শি রাম মণ্ডল, জন্মেজয় মণ্ডলেরা বলেন, “যুগ্ম বিডিও এসেছিলেন। তাঁকে আমরা জানিয়েছি, একে ধান বিক্রি হয়নি, তার উপরে বোরো চাষও করতে পারবে না ভেবেই প্রসেনজিৎ আত্মঘাতী হয়েছে।” মোষ কেনা নিয়ে অশান্তির জেরেই এই আত্মহত্যা দাবি করেও স্থানীয় নিরোল পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান উত্তম দাস মেনে নেন, “সহায়ক মূল্যে ধান কেনার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা হয়নি। কিষান ক্রেডিট কার্ডও চাষিদের হাতে পৌঁছয়নি।”
মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দল না মানলেও চাষিমৃত্যু নিয়ে রাজ্য রাজনীতি যথেষ্ট উত্তপ্ত। বাম, বিজেপি, এমনকী জোট শরিক কংগ্রেসও সমালোচনায় সরব। পরিস্থিতি মোকাবিলার দাবিতে এ দিন হুগলির চুঁচুড়ায় রাস্তায় নামে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন। কাল, রবিবার তিনি বর্ধমানের গলসিতে আত্মঘাতী চাষি সুশান্ত ঘোষের বাড়ি যাবেন জানিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “বাম জমানায় কোনও চাষি আত্মহত্যা করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাড়ি গিয়ে বামফ্রন্টের মুণ্ডপাত করে ক্ষতিপূরণ দাবি করতেন। আর নিজে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বলছেন, কোনও চাষি ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেননি!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও বলেন, “রাজ্য সরকারের আত্মঘাতী চাষিদের পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।” |
|
|
|
|
|