করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের আউটডোরের সামনে টাঙানো একটা বিরাট হোর্ডিং রয়েছে জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম নামে। সেই হোর্ডিং-এ লেখা, সম্পূর্ণ নিখরচায় গর্ভবতী মা ও জন্মের ৩০ দিনের মধ্যে অসুস্থ নবজাতকের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসার পাশাপাশি যাবতীয় পরিষেবা দেবে স্বাস্থ্য দফতর। সরকারি নির্দেশিকা পাওয়ার পরে গত নভেম্বর, ডিসেম্বরের মধ্যে জেলার সব হাসপাতাল, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমনকী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও টাঙানো হয়েছে ওই হোর্ডিং। সরকারি নির্দেশ মানা হল ঠিকই, কিন্তু সেই হোর্ডিং এ লেখা পরিষেবা কি মিলছে?
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার পাল্টা প্রশ্ন- এটা এই মূহুর্তে সম্ভব না কি? ওই কর্তার কথায়, জেলার প্রায় সব হাসপাতালেই প্রয়োজনের তুলনায় ওষুধের ঘাটতি রয়েছে। খুব সাধারণ ওষুধ কিংবা গ্লাভস, স্যালাইন, ব্যান্ডেজও মাঝে মাঝে অমিল হয়ে যায়। রোগীদের সেগুলো বাইরে থেকে কিনতে হয়। এ বার সে সবের সমাধান না করেই এই হোর্ডিং তৈরি করেও টাঙাতে ভয় পাচ্ছিলেন অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এই হোর্ডিং টাঙানো ব্যধ্যতামূলক ছিল। তাই টাঙানো হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো, চিকিৎসক, ওষুধ ও অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ না হলে ওই লেখাগুলো হোর্ডিংয়েই থাকবে। বাস্তবে কোনওদিন সম্ভব হবে না। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘সমস্যাটা তো তৈরি হচ্ছে এখান থেকেই। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ‘আছে’র থেকে ‘নেই’ এর তালিকাটাই অনেক লম্বা। অথচ পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি না ঘটিয়ে হাসপাতালের মধ্যেই একটা বিরাট হোর্ডিং টাঙিয়ে দেওয়া হল।” শঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘পাশাপাশি এটাও ঠিক যে মানুষকে সচেতন করতে স্বাস্থ্য দফতরের প্রচার ব্যাপক কাজে লেগেছে।’’
করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালসূত্রে জানা গিয়েছে, এই হাসপাতালে যেভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে সেই অনুপাতে কিন্তু পরিকাঠামোর কোন উন্নতি হয়নি খাতায় কলমে হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা মাত্র ৫০টি। এদিকে ওই ৫০ টি শয্যা ও প্রায় দু’লক্ষ মানুষের হিসাবেই হাসপাতালে ওষুধ, প্রতিষেধক বা প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী আসে ওই একই অনুপাতে চিকিসক, নার্স, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট, ডোম, ঝাড়ুদার যে সংখ্যায় থাকার কথা তার থেকেও কম রয়েছে।
এবার বাস্তব চিত্রটার দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। করিমপুর ও আশপাশের এলাকার অন্তত পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। শীতের কয়েক মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় রোগীদের শয্যা পাওয়া তো দুরের কথা মেঝেতে জায়গা পাওয়াও দায় হয়ে পড়ে। কারণ শয্যা সংখ্যা তো সেই ৫০! ওই পুরনো হিসাবেই জেলা থেকে একমাসের জন্য যে পরিমাণ ওষুধ বা অন্যান্য সামগ্রী আসে তা পনেরো দিনের আগেই ফুরিয়ে যায়। এবার চিকিসক, নার্স বা হাসপাতালে অন্যান্য যে কর্মীরা আছেন তা ওই বিপুল সংখ্যক রোগীর তুলনায় অতি সামান্য। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় চিকিসকদেরও। সব মিলিয়ে সমস্যায় পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে এক্স রে ফিল্মের সরবরাহ না থাকার কারণে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের এক্স রে পরিষেবা এক্স রে করার ঘরের বন্ধ দরজায় ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য এক্স রে বন্ধ’ বলে নোটিস ঝুলিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দূরদুরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ রোজ এক্স রে করতে এসে হয়রান হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সাধারণ কোনও অসুখ বিসুখে গ্রামের মানুষ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রতে গিয়েই প্যারাসিটামল, ওআরএস বা মেট্রোজিলের মতো কিছু ওষুধ পেতেন। করিমপুর ১ ব্লকের ২৭ টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে গত তিন মাস ধরে কোনও ওষুধ নেই। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকলেও অ্যানাসথেটিস্টের অভাবে তা বন্ধ।
করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের সুপার বিধুভূষণ মাহাতো বলেন, ‘‘রোগীর সংখ্যা যে ভাবে বেড়েছে, সেই ভাবে কিন্তু ওষুধের সরবরাহ বা হাসপাতালের পরিকাঠামো বাড়েনি। এ বার দু’লক্ষ মানুষের জন্য যে ওষুধ আমরা পাই, তাই দিয়েই পাঁচ লক্ষ মানুষের কাজ চালাতে হয়। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও অনেকদিন থেকেই ওষুধ নেই। আমাদের এখানে অস্ত্রোপচার না হওয়ার জন্য গড়ে প্রায় ২২ থেকে ২৫ শতাংশ প্রসূতিকে আমরা জেলা হাসপাতালে রেফার করতে বাধ্য হই। এই সব কারণেই আমাদের মাঝে মধ্যেই সমস্যায় পড়তে হয় গোটা বিষয়টি জেলা স্বাস্থ্য দফতরকেও জানানো হয়েছে।’’ |