ত্রাসের তিন চাকা/১
ভাড়া থেকে রুট, অটোচালকের মর্জিই শেষ কথা
রাত সওয়া ১০টা। সল্টলেকের সিটি সেন্টারে সবে সিনেমার শো ভেঙেছে। বান্ধবীকে নিয়ে উল্টোডাঙাগামী অটোয় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী অনির্বাণ সরকার। গম্ভীর গলায় অটোচালক বলছেন, “৫০ টাকা লাগবে কিন্তু। তার কমে হবে না!” থতমত খেয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিরিক্ষে জবাব, “৫০ টাকায় পোষালে উঠুন, না-হলে অন্য রাস্তা দেখুন।”
তত ক্ষণে সেখানে হাজির একটি ট্যাক্সি। অনির্বাণেরা সে দিকে এগোতেই এক সঙ্গে তিন জন অটোচালক প্রায় তেড়ে গেলেন। এ বার ট্যাক্সিচালককে লক্ষ করে শাসানি, “এরা আমাদের প্যাসেঞ্জার। এখানে হাত বাড়াস না!” শুনে গাড়ির গতি বাড়ালেন ট্যাক্সিচালকও। অটোর এই ‘মহাজোট’-এর সামনে হতভম্ব তরুণ-তরুণী তখন কিংকতর্ব্যবিমূঢ়। যাত্রীদের অনেকেরই অভিযোগ, রাত একটু বাড়লেই সিটি সেন্টার থেকে উল্টোডাঙা যাওয়ার ভাড়া বেড়ে যায়। যাত্রী কম দেখলে অটো ‘বুক’ করার ফতোয়াও হামেশাই চাপিয়ে দেন অটোচালকেরা।
শহরের অন্য রুটগুলিও পিছিয়ে নেই। সকাল থেকে রাত, যখন-তখন মর্জিমাফিক পথ বদল, বাড়তি ভাড়া দাবি, স্টিরিওয় কানে তালা ধরানো গান কিংবা বিপজ্জনক যাতায়াত অটো-রাজের ছবিটা সর্বত্রই এক।
নিষেধ অগ্রাহ্য করে যেখানে সেখানে চলছে যাত্রী তোলা। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
নাগেরবাজার-দমদম স্টেশন রুট: সকাল পৌনে ১০টা। অটোর জন্য হা-পিত্যেশ করা লাইনটা নাগেরবাজার পেট্রোল পাম্প ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় মিনিট কুড়ি স্ট্যান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে ঘড়ি দেখছিলেন কলেজছাত্রী তৃষা গঙ্গোপাধ্যায়। নিয়ম মেনে লাইনে অপেক্ষা করলে অটোর দেখা মিলবে না ধরে নিয়েই কিছুটা এগিয়ে গেলেন তিনি। রহস্যটা তখনই পরিষ্কার। স্টেশন থেকে আসা বেশির ভাগ অটোই নাগেরবাজার পর্যন্ত না-গিয়ে আগে ঘুরে যাচ্ছে। গরুহাটা মোড়ের কাছে ভিড় থেকেই যাত্রী তুলে পিঠটান। দিনের ব্যস্ততম সময়ে ওই জটলা ঠেলে অটোয় একটা সিট পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন তৃষাও।
জোড়াবাগান-উল্টোডাঙা রুট: বিকেল পাঁচটা। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে, অরবিন্দ সরণির মোড়ে অটো থামিয়ে চালকের পাশে বসেছিলেন সল্টলেকের বাসিন্দা শৌনক সেনগুপ্ত। পিছনের সিটে আগেই তিন জন বসে। নিয়ম অনুযায়ী চার জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না অটোয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শৌনক সিটে বসতে না-বসতেই ভিতরে ‘চেপে’ বসার নির্দেশ এল। পঞ্চম যাত্রীটিকে জায়গা দিতে অটোচালক নিজেও আরও ডান দিকে সরে গেলেন। সামনে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা দু’জন যাত্রী নিয়ে ব্যস্ত রাজপথে শুরু হল অটোর ‘বিপজ্জনক’ সফর।
গণেশ টকিজ-ফুলবাগান রুট: সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। অফিসযাত্রীদের ভিড়ে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের কাছে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অর্ণব রায়। একটা অটোকে থামাতেই চালকের হুঁশিয়ারি, “দাদা, কাঁকুড়গাছির পরে যাব না কিন্তু!” অথচ, অটোর গায়ে লেখা রুট মানলে ফুলবাগান পর্যন্ত যাওয়ার কথা। ‘প্রতিবাদ’ করে যে লাভ হবে না, অর্ণববাবু বিলক্ষণ জানেন। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, সন্ধে ঘনাতেই মর্জিমাফিক গন্তব্য স্থির করে নেওয়াটা এই রুটের চালকদের অনেক দিনের অভ্যাস।
যাদবপুর থানা-রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো রুট: রাত প্রায় ন’টা। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড লাগোয়া শপিং মল থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনগামী অটোর খোঁজ করছিলেন গৃহবধূ আত্রেয়ী গুহঠাকুরতা। অটোয় উঠতে যেতেই ‘সতর্ক’ করলেন চালক, ‘‘দু’টাকা এক্সট্রা লাগবে বৌদি।’’ কেন? চালকের ছোট্ট জবাব, “রাত হয়েছে তো!”
তারাতলা-ঠাকুরপুকুর রুট: রাত পৌনে ১০টা। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটোর খোঁজ করছিলেন প্রৌঢ় সেন দম্পতি। স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো কোনও অটোই ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত যেতে রাজি নয়। একই অভিজ্ঞতা ওই রুটের অন্য যাত্রীদেরও। তাঁদের রোজকার অভিযোগ: ওই রুটটি ‘ভেঙে’ অলিখিত ভাবে দু’টি রুট তৈরি করেছেন চালকেরা। তারাতলা থেকে ওঠা যাত্রীদের নামানো হয় বেহালা চৌরাস্তায়। সেখান থেকে ফের লাইন দিয়ে নতুন অটো ধরে ঠাকুরপুকুর।
শহরবাসীর অভিজ্ঞতায় অটোচালকদের এই ‘যথেচ্ছাচার’ কলকাতার বিভিন্ন রুটে প্রাত্যহিক ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রেই কতর্ব্যরত পুলিশের চোখের সামনেও নিয়ম ভাঙার অভিযোগ ওঠে। অথচ, কলকাতা এবং লাগোয়া এলাকায় মোট কত অটো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, পরিবহণ দফতর থেকে শুরু করে পুলিশ বা রাজনৈতিক দল কারও কাছেই তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। লালবাজারের ট্রাফিক বিভাগের কর্তাদের হিসেব, শহরে নথিভুক্ত অটোর সংখ্যা কম-বেশি ৩৫ হাজার। তবে, বাস্তবে যত অটো রাজপথে দেখা যাচ্ছে, তা এর চেয়ে ঢের বেশি বলেই পুলিশকর্তাদের অভিমত।
বেলতলায় মোটর ভেহিক্লস (এমভিআই) বিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানান, তাঁদের দফতরে নথিভুক্ত অটোর সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। দক্ষিণ ২৪ পরগনার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক চপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জেলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার ‘রেজিস্টার্ড’ অটো রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চলে কলকাতায়, বাকিগুলি অন্যত্র।” এই সব নথিভুক্ত অটোই যাত্রী পরিবহণের ‘পারমিট’ পাওয়ার অধিকারী। এমভিআই-কর্তারা ঠারেঠোরে মানছেন, খাস কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে যে সব অটো, তাদের অনেকের আদপে পারমিটই নেই। অভিযোগ, অটোকর্মীদের মাথায় ‘রাজনৈতিক দাদা’দের হাত। পুলিশের দাবি, পারমিটবিহীন অটোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ওই ‘দাদা’রাই অটোর ‘ত্রাতা’ হয়ে ওঠেন।
রাজনীতির পালা-বদল দেখেছে কলকাতা তথা রাজ্য। কিন্তু শহরবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, রাজপথে অটো-রাজের কোনও ‘পরিবর্তন’ নেই এখনও দেখা যায়নি।

(চলবে)
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.