মুখ্যমন্ত্রী নিজে দেখতে চেয়েছিলেন ছবিটা। তাঁর উৎসাহেই সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে ‘খোকাবাবু’ ছবির বিশেষ প্রদর্শনের ব্যবস্থা হয়েছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। শো-এর পরে কলকাতার সংস্কৃতি জগতের গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন। সবই হল। শুধু এসআফএফটিআই-এর ছাত্রছাত্রীদের নীরব প্রতিবাদে দিনভর ‘মুখর’ হয়ে থাকল এসআরএফটিআইয়ের চত্বর।
প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকের সামনের রাস্তা থেকে শুরু করে যে প্রেক্ষাগৃহে বসে মুখ্যমন্ত্রী ছবি দেখলেন, সর্বত্র ছবিটির প্রদর্শনের প্রতিবাদে এ দিন পোস্টার সেঁটে দেন ছাত্রছাত্রীরা। দেওয়াল থেকে বাহারি গাছের টব—লেখা ছিল দু’টি শব্দ। ‘উই কনডেম’। কেন? পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী গোটা ব্যাপারটাকেই একটা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কথায়, পড়ুয়ারা ভেবেছিলেন শো-পরবর্তী পার্টির আয়োজক কোনও বেসরকারি সংস্থা। “কিন্তু এটা সরকারি অনুষ্ঠান, ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের লিখিত অনুমতি নিয়েই আয়োজন করা হয়েছে। এটা বোঝার পর সব মিটে গিয়েছে।” |
সবটা মিটে যায়নি অবশ্য। সেই কারণেই সন্ধ্যা সওয়া ৭টা নাগাদ মূল ফটক এড়িয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অন্য একটি গেট দিয়ে প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় পুলিশকে। প্রেক্ষাগৃহের মূল গেটের কাছে পুলিশি ঘেরাটোপের ‘নজরদারি’তে তখনও দল বেঁধে বসেছিলেন কালো ব্যাজধারী জনা ৭০ ছাত্র-ছাত্রী। রাজ্যের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বা মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেন মুখ্যমন্ত্রী ঢোকার আগে পড়ুয়াদের বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। মুখ্যমন্ত্রীকেও যে তাঁরা সরাসরি কিছু বলতে চেয়েছিলেন এমন নয়। কালো ব্যাজধারীরা আগেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এটা তাঁদের নীরব প্রতিবাদ।মমতা প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার সময়ে কেউ কর্ডন ভেঙে তাঁর কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা করেননি ঠিকই। কিন্তু ‘খোকাবাবু’ দেব যখন মুখ্যমন্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন পড়ুয়াদের একাংশ সরব হন।
প্রতিবাদের হেতু? পড়ুয়াদের বক্তব্য, “এই প্রেক্ষাগৃহে রোজ সন্ধ্যায় দেশ-বিদেশের ছবি দেখিয়ে আমাদের সিনেমার কৃৎকৗশলের কোনও না-কোনও দিক শেখানো হয়। হঠাৎ একটা নোটিস দিয়ে সেটা কেন বন্ধ করে দেওয়া হবে?” কিন্তু এসআরএফটিআই প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে সিনেমা প্রদর্শনের নজির তো আছেই। আছে ওই চত্বরে ছবির শু্যটিংয়ের দৃষ্টান্তও। হরনাথ প্রশ্ন তোলেন, ‘‘দিদি রেলমন্ত্রী থাকার সময়েও তো ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য এসআরএফটিআই-এ এক বার জমায়েত হয়েছিল। তার পরেও এ রকমই নৈশভোজের আয়োজন ছিল।” এখন তা হলে আপত্তি কেন? এ দিনের ‘শো’-কে কেন্দ্র করে ভিআইপিদের ভিড়ের জন্য বিকেল থেকে পুলিশি নিরাপত্তার আয়োজনে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয়েছে বলে পড়ুয়াদের অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, ছবি প্রদর্শন নিয়ে তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু ওই চত্বরে বিশাল ম্যারাপ বেঁধে যে ‘পেজ-থ্রি’ ধাঁচের জমায়েতের ব্যবস্থা হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানের মেজাজকে ‘ক্ষুণ্ণ’ করেছে। ‘খোকাবাবু’র নায়ক দেব অবশ্য বলেন, “খোকাবাবু’ দেখাটা একটা অংশমাত্র। আমাদের সঙ্গে দিদির সব সময় তো কথাবার্তা হয় না! দিদিই চেয়েছিলেন, একসঙ্গে দু’টো কাজই যাতে হয়ে যায়।”
বস্তুত রাজ্যে ক্ষমতায় আসার কিছুদিন আগে থেকেই টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলেন মমতা। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ফিল্মোৎসব, ফিল্ম ইনস্টিটিউটের যোগাযোগ বাড়ানোয় আলাদা করে তাঁর উৎসাহ রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য তাঁর পছন্দের জায়গা নন্দন নয়, থেকেছে এসআরএফটিআই-ই। এ দিনের ছবি দেখা এবং নৈশভোজের আসর সেই প্রয়াসেরই অঙ্গ। কিন্তু এসআরএফটিআইয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বড় অংশ এই প্রবণতাটিরই বিরোধিতা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, এসআরএফটিআই একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। তার পঠনপাঠন আন্তর্জাতিক স্তরের। পড়ুয়াদের মধ্যে খুব অল্প অংশই বাঙালি। ফলে তাঁদের মতে, এসআরএফটিআই-কে টালিগঞ্জের সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজে লাগালে তাকে একটি আঞ্চলিকতায় বেঁধে ফেলা হয়। সেটা বাঞ্ছনীয় নয়।
দিনের এই ‘প্রতিবাদী’ আবহ অবশ্য রাতের অনুষ্ঠানে কোনও প্রভাব ফেলেনি। |