উলটপুরাণ পানপাড়ায়।
বাজারে এখন ৫০ কেজি আলুর বস্তার দর ১১০
টাকা। কিন্তু হুগলির পানপাড়া মৌজার শ’দুয়েক চাষি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে আলু বিক্রি করবেন ৩০০
টাকারও বেশি দরে! আলুর এই দরও তাঁরা জেনেছিলেন ন’মাস আগে।
হাওড়ার কারখানায় প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্রসেসড ফুড) তৈরির জন্য ওই চাষিদের কাছ থেকে আলু কেনে বহুজাতিক সংস্থা পেপসিকো-ইন্ডিয়া। প্রায় দশ বছর ধরে তাঁদের কাছ থেকে এ ভাবে আগাম দর জানিয়ে আলু কিনছে সংস্থাটি। এবং তার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে।
রাজ্য জুড়ে সাধারণ আলুচাষিরা যখন চাষের খরচ তুলতেই হিমসিম খাচ্ছেন, লোকসানের পাহাড়ে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ, তখন পেপসিকো-ইন্ডিয়া-র জন্য আলু চাষ করে এমন উল্টো ছবিই দেখছেন ‘পানপাড়া সেচ অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র প্রায় দু’শো জন চাষি। প্রায়
২৯ একর জমিতে বহুজাতিক সংস্থাটির জন্য আলু চাষ করছেন তাঁরা।
এই চাষিরা বলছেন, গোটা প্রকল্পটির ব্যবসায়িক কৌশলই তাঁদের বাজার ও দামের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা দিয়েছে। যেখানে খরচের প্রেক্ষিতে আলুর দরটাই আগে থেকে ঠিক করা থাকে বলে লাভ বই লোকসান হয় না। বস্তুত, দালাল না থাকা, আলুর বাজার ও তার দর আগাম স্থির হওয়ার কারণে গোটা প্রক্রিয়াটিকেই অনেক স্বচ্ছ বলে মনে করছেন চাষিরা। তাই এ ধরনের কৃষিপণ্য উপাদনের ক্ষেত্রে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন বেসরকারি পুঁজিকে।
রাজ্যে তাঁদের কর্মপন্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে বৃহস্পতিবার পানপাড়া মৌজায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বহুজাতিক সংস্থাটির কর্তারা। সেখানেই ছিলেন তারক নায়েক, মহাদেব প্রামাণিক, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো বহু আলুচাষি। তাঁদের দাবি, চুক্তিতে হলেও যে পদ্ধতিতে বহুজাতিক সংস্থাটির জন্য তাঁরা আলু চাষ করেন, তা অনেক বেশি ‘সুরক্ষিত’। বাজারের ওঠাপড়ার আঘাত কার্যত নেই। চাষের খরচের আগাম হিসেব করে তারই ভিত্তিতে ঠিক হয় পরের বছর আলু ওঠার সময় চাষি কী দাম পাবেন। আর চুক্তি মোতাবেক তার পুরোটাই কিনে নেয় সংস্থাটি।
ফলে দামের মতোই বাজার নিয়েও কোনও সংশয় নেই। অমরবাবু বলেন, “এ বার ওঁরা ৫০ কেজির বস্তা পিছু ৩০০-৩২০ টাকা দেবেন বলেছেন।”
২০০৩-এ প্রথম বার বহুজাতিক সংস্থাটির জন্য এক একর জমিতে আলু চাষ করেন তারকবাবু। সব মিলিয়ে তাঁর আট একর জমি। তার মধ্যে ৬ একর জমিতে এ বার তিনি চাষ করছেন। পুণ্যগ্রামের মহাদেব প্রামাণিক আবার এই বারই প্রথম বহুজাতিক সংস্থাটির জন্য আলু চাষ করেছেন। গত বছর আলুর দর না পাওয়ায় প্রায় দশ হাজার টাকা ঋণের বোঝা এখনও তাঁর মাথার উপরে। এ বার তাই নিজের দু’একর জমির মধ্যে এক একরে ‘পেপসিকো’র জন্য আলু চাষ করছেন তিনি।
কিন্তু আলুর গুণমান খারাপ হলে এবং সংস্থাটি তা না নিলে তখন কী হবে? চাষিদের বক্তব্য, সাধারণ চাষের ক্ষেত্রেও কিছু আলু খারাপই থাকে। বরং পেপসিকো-র চাষের পদ্ধতি ঠিকমতো মানলে খারাপ আলু কম বই বেশি হয় না বলেই তাঁরা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছেন। কিন্তু বাজারে আলুর দরও তো বেশি উঠতে পারে। বস্তুত, ২০০৮-এ বহুজাতিক সংস্থাটি যে দাম দিয়েছিল তার চেয়ে বাজারদর কিছুটা বেশিই উঠেছিল। সে কথা মেনেও চাষিদের দাবি, তখনও তাঁদের লাভের অঙ্কটা যথেষ্ট ছিল। বরং বাজারদর কমলেই লোকসানের ভয় বেশি। আলুচাষি অনিলবাবু জানালেন, গত বছরও বিঘা প্রতি তাঁর লাভ হয়েছে প্রায় সাত হাজার টাকা।
আগাম খরচের হিসেব ধরে দর স্থির করলেও তো সমস্যা হতে পারে, বিশেষত বীজ খারাপ হলে।
তখন লোকসানের দায় কে নেবে? সোসাইটির সম্পাদক জানালেন, ২০০৮-এ ওই এলাকার প্রায় ১১ একর জমিতে খারাপ বীজের জন্য ফলন মার খেয়েছিল। পরে কিন্তু চাষিরা বীজ ও ওষুধের দাম ফেরত পেয়ে গিয়েছিলেন। দাম স্থির হয়ে যাওয়ার পরে চাষের খরচ অনেক বাড়লে লাভের অঙ্কটা যে কমে, মানছেন চাষিরা। কিন্তু তাঁদের দাবি, এতে লোকসান হয় না, ঋণের বোঝাও মাথায় চাপে না।
সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (অ্যাগ্রো) জয়দীপ ভাটিয়া জানান, ২০১০-এ তাঁরা এ রাজ্য থেকে ২২ হাজার টন আলু কিনেছিলেন। ২০১১-এ তা বেড়ে হয় ৪০ হাজার টন। এই বছরে রাজ্যের ছ’টি জেলা থেকে ৬০ হাজার টন আলু কেনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির হাওড়ার কারখানায় এখন ৮০ হাজার টনের বেশি আলু লাগে।
সে ক্ষেত্রে আগামী বছর চাহিদার পুরোটাই এ রাজ্য জোগাবে বলে তাঁদের আশা। সে কথা মাথায় রেখেই এখনকার চেয়ে আরও বেশি আলু মজুত করার পরিকাঠামোও তৈরি করছে সংস্থাটি। |