স্বাস্থ্য দফতরের লিখিত নির্দেশনামা অনুযায়ী হাসপাতালে টাকা জমা পড়ছে। অথচ তার কোনও রসিদ দেওয়া হচ্ছে না! সেই টাকা কোথায়, কাদের কাছে যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। বছরের পর বছর এ ভাবেই লক্ষ লক্ষ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল বোর্ডে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত কয়েক জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সম্প্রতি একটি অভিযোগ দায়ের করে জানান, বোর্ডে মেডিক্যাল পরীক্ষা করার পারিশ্রমিক বাবদ যে টাকা তাদের পাওয়ার কথা, সেটা তাঁরা দীর্ঘদিন পাচ্ছেন না। মেডিক্যাল টেস্টের জন্য আসা প্রার্থীরা সেই টাকা জমা দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের রসিদ দেওয়া হচ্ছে না। তার পর সেই টাকা মেডিক্যালের কিছু কর্মী এবং স্বাস্থ্য দফতরের কিছু কর্মীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্যসচিবের দফতরে। খবর দেওয়া হয়েছে লালবাজারেও।
বিষয়টি যাঁদের দেখার কথা, স্বাস্থ্য দফতরের সেই মার্ট বিভাগের কর্তারা বছরের পর বছর মেডিক্যাল বোর্ডের টাকা উধাও হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মার্টের ডেপুটি ডিরেক্টর অরুণেন্দু বিশ্বাসের কথায়, “২০০৯ সালের মে মাসের একটি অর্ডার অনুযায়ী, মেডিক্যাল টেস্ট করানোর জন্য মেডিক্যাল বোর্ডে টাকা জমা দেওয়ার কথা। বোর্ডে যে তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবেন, টাকাটা তাঁদেরই প্রাপ্য। কিন্ত খবর নিয়ে জেনেছি, সত্যিই এই টাকা নিয়ে কোনও রসিদ দেওয়া হয় না। ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। বোর্ডের ডাক্তারেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।”
এ ভাবে কত টাকা নয়ছয় হয়েছে? স্বাস্থ্য দফতর ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রের খবর, বছরে ন্যূনতম ৭-৮ লক্ষ টাকা থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সেন্ট্রাল মেডিক্যাল বোর্ডে জমা পড়ার কথা, যা বিনা রসিদে জমা পড়েছে, তার পরে কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না। সরকারি চাকরি পাওয়া প্রার্থীরা শারীরিক পরীক্ষা করাতে ওই বোর্ডে যান। নিয়মানুযায়ী, তাঁদের চাকরির নিয়োগপত্র, রক্ত ও মূত্র পরীক্ষার রিপোর্ট ও অন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং ১০০ টাকা মেডিক্যাল বোর্ডে জমা দিতে হয়। এই ১০০ টাকার মধ্যে ২৫ টাকা ট্রেজারি চালান হিসেবে ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়। আর বাকি ৭৫ টাকা নগদে বোর্ডে জমা পড়ে। বোর্ডে তিন জন বিশেষজ্ঞ থাকেন। এক জন চক্ষু বিশেষজ্ঞ, এক জন সার্জেন বা অর্থোপেডিক সার্জেন ও এক জন ফিজিশিয়ান। ওই ৭৫ টাকা এই তিন জনের পাওয়ার কথা। কিন্তু সেই টাকা অন্য ভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে।
এত দিন কী ভাবে স্বাস্থ্যকর্তাদের নজর এড়িয়ে গেল বিষয়টি? মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, এটা স্বাস্থ্য ভবনের মার্ট বিভাগের দেখার কথা। মার্টের কর্তা অরুণেন্দুবাবুর আবার বক্তব্য, এটা দেখবেন মেডিক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যানই। প্রাক্তন চেয়ারম্যান তুষারকান্তি ঘোষের কথায়, “অনেক বার মার্টে জানানো হয়েছে যে, টাকাটা অন্য ভাবে ভাগ হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যভবন থেকে বলা হয়েছে, টাকার অঙ্ক এমন কিছু বেশি নয়। ওটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।” সদ্য প্রাক্তন প্রধান কুন্তল বিশ্বাসের বক্তব্য, “পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। এখন কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়।”
মেডিক্যাল কলেজের হিসেব অনুযায়ী, এক সপ্তাহে মেডিক্যাল বোর্ডে ন্যূনতম ৯০-১০০ জন শারীরিক পরীক্ষার জন্য আসেন। প্রত্যেকেই ৭৫ টাকা জমা দেন। সেই হিসেবে মাসে কম করে ৩০-৩২ হাজার টাকা জমা পড়ে। তার কোনও রসিদ থাকে না। কী ভাবে সেই টাকা খরচ হয়, তা নিয়েও স্বাস্থ্যকর্তারা অন্ধকারে। মেডিক্যাল কলেজের কয়েক জন চিকিৎসক ও মেডিক্যাল বোর্ডে যুক্ত কিছু কর্মীই জানালেন, বোর্ডেরই কয়েক জন নিজেদের মধ্যে টাকাটা ভাগ করে নেন। সেটা যাতে স্বাস্থ্য দফতরে না পৌঁছয়, তাই রসিদ দেওয়া হয় না। ওই কর্মীদের অভিযোগ, বোর্ডে শারীরিক পরীক্ষা করাতে আসা প্রার্থীদের কাগজপত্র আনা-নেওয়া করার জন্য মার্ট বিভাগের কিছু করণিক প্রত্যেক সপ্তাহে বোর্ডে আসেন। টাকা তাঁদের মধ্যেও ভাগ হয়। মাঝখান থেকে যে চিকিৎসকদের টাকা পাওয়ার কথা, তাঁরা বঞ্চিত থেকে যান। |