সরকারকে ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বলার ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার কলকাতা ছেড়ে বহরমপুরে ফিরে গেলেন মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী। এ দিনই তাঁর সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের। কিন্তু তিনি দলীয় কাজে দুর্গাপুরে এবং মনোজবাবু বহরমপুরে চলে যাওয়ায় বৈঠক হয়নি। তবে দুর্গাপুরে প্রশ্নের জবাবে প্রদীপবাবু বলেন, “মনোজের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওর মনে একটা দুঃখ, বেদনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ওর কাজ করতে অসুবিধা হয়েছে। ও অব্যাহতি চেয়েছে। ওকে অব্যাহতি দেওয়া হবে কিনা, তা আমি একক ভাবে ঠিক করতে পারি না। দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত হবে।” মনোজবাবুর ব্যাপারে ‘দু-একদিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার’ বলেও তিনি জানান।
তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনায় প্রদীপবাবু ও তাঁর অনুগামীরা যখন সরব, দলীয় দুই মন্ত্রীর ব্যাপারে কংগ্রেসের একাংশ যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় ‘ক্ষুব্ধ’, ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে তখনই মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে সর্বভারতীয় স্তরে সওয়াল করেছেন কংগ্রেসের নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। গুয়াহাটিতে ‘ব্রহ্মপুত্র রিভার বোর্ডে’র বৈঠকে বোর্ডের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পর্যালোচনা কমিটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে স্থায়ী সদস্য করার জন্য কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী পবন বনশলের কাছে দাবি জানান মানসবাবু। বৈঠকের পরে মানসবাবু জানিয়েছেন, একই দাবি জানিয়ে তিনি চিঠি দেবেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কেও। কংগ্রেসের একাংশের বক্তব্য, হাইকম্যান্ড যেহেতু মমতার সঙ্গে ‘সঙ্ঘাতে’র রাস্তায় যেতে নারাজ। সেই ‘লাইন’ মেনেই মানসবাবুর ওই সওয়াল। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, “ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীকে তুষ্ট রাখতেই মানসবাবু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।’’ |
মনোজবাবু এ দিন ফের জানিয়েছেন, তিনি আর মন্ত্রিত্বে ফিরবেন না। ইস্তফা দিতে অনুমতি চেয়ে তিনি কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার কোনও জবাব এসেছে? মনোজবাবু বলেন, “না। দিল্লি থেকে কোনও নির্দেশ পাইনি। তবে দলের সর্বস্তরের নেতাদের জানিয়ে রেখেছি, আমায় মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। আমি আমার বিধানসভা কেন্দ্র বহরমপুরেই কাজ করতে চাই। আমার আশা, দলীয় নেতৃত্ব আমার আর্জি মঞ্জুর করবেন।”
মনোজবাবু ইস্তফা দিলে তাঁর জায়গায় কে মন্ত্রী হবেন বা আদৌ দলের কাউকে মন্ত্রী করা হবে কিনা, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রদেশ কংগ্রেসে জল্পনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রদীপবাবুর মন্তব্য, “আগে মনোজের ব্যাপারটা চূড়ান্ত হোক। তারপরে তো অন্য কথা!”
বস্তুত, কংগ্রেসের দুই মন্ত্রী মনোজবাবু ও আবু হেনার দফতর কাটছাঁট নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রদীপবাবু ও সেচমন্ত্রী মানসবাবুর অনুগামীরা আড়াআড়ি দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। দফতর কাটছাঁটের পর মানসবাবুর বিরুদ্ধে ‘দ্বিচারিতা’র অভিযোগ এনেছিলেন মনোজবাবু। প্রদীপবাবু কিন্তু স্পষ্টতই মনোজবাবুর পাশে। এমনকী, তৃণমূলের নেতৃত্বের মানসিকতায় যে তিনি ‘খুশি’ নন, তা এ দিন দুর্গাপুরে ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে কংগ্রেসের বিক্ষোভ সভায় প্রদীপবাবুর বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেন,“আমরা চাই, সিপিএমের কায়দায় তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার যেন পরিচালিত না হয়। সিপিএমের হাতে ফের রাজ্যকে তুলে দেওয়ার রাস্তা আমরা করব না। কিন্তু সাধারণ মানুষ-কৃষক-মজুরদের পাশে দাঁড়াব। তাদের ক্ষতি হলে বলব। চাষিরা যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পান তা সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। কারণ তাঁরাই ভোট দিয়ে এই সরকার গড়েছেন।”প্রদীপবাবুর আরও বক্তব্য, “কংগ্রেস জাতীয় দল। কংগ্রেসকে কেউ কেউ তাচ্ছিল্য, তিরস্কার, বিদ্রূপ করছেন। কিন্তু রাজ্যের মানুষ চান, কংগ্রেস থাক। কর্মীরা মাথা উঁচু করে কংগ্রেসের কর্মসূচি পালন করুন।” তাঁর কথায়,“নির্বাচনের পরে আমরা সমন্বয় কমিটি গড়ার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি। তা হলে বিভিন্ন বিষয়ে দুই দলের মতপার্থক্য এ ভাবে প্রকাশ্যে আসত না।”
মানসবাবু এ দিন জানান, মুখ্যমন্ত্রীর ‘নির্দেশে’ই তিনি গুয়াহাটির বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “এর মধ্যে রাজনীতি নেই। রাজ্যের স্বার্থেই কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছি। ব্রহ্মপুত্র রিভার বোর্ডের হাই-পাওয়ার রিভিউ কমিটিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেই স্থায়ী সদস্য হিসাবে রাখা হয়নি। তাঁকে রাখা হয়েছে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে। এ রাজ্যের উত্তরবঙ্গ দিয়ে বয়ে যাওয়া ৭৬টি নদী পড়েছে ব্রহ্মপুত্রে। সেই সমস্ত নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণে, ভাঙন রোধে বোর্ড যাতে অর্থ বরাদ্দ করে সে জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর স্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকা দরকার।” এ জন্য যে আইন আছে, তা সংশোধন করা দরকার জানিয়ে মানসবাবু বলেন, “সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী ও প্রণব’দার কাছে চিঠি লিখছি।”
এমনিতে তৃণমূল শিবির মনোজবাবুর ঘটনাকে ‘উপেক্ষা’ করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও তা-ই চান। তবুও এ দিন বিধাননগর মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেন, “মনোজবাবু বলছেন, হাইকম্যান্ড বললে ইস্তফা দেবেন এবং আর মহাকরণে আসবেন না। এখন তিনি যা করছেন, তা-ও কি হাইকম্যান্ডের নির্দেশেই?”
সে ক্ষেত্রে কি মনোজবাবুর আচরণের পিছনে অন্য কারও মদত রয়েছে? পুরমন্ত্রী বলেন, “পুলিশ-প্রশাসনকে দলতন্ত্রের বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে যারা অপরাধী নিয়ে ওঠাবসা করে, তাদের অসুবিধা হচ্ছে। তাই তারা সরকারের বিরোধিতা করছে।” নাম না-করলেও পুরমন্ত্রীর ইঙ্গিত কংগ্রেসের সাংসদ অধীর চৌধুরীর দিকেই। এর আগেও অধীরকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। কংগ্রেসি রাজনীতিতে মনোজবাবু ‘অধীর-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত।
তবে মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাঁর ঘনিষ্ঠমহলে এদিন জানিয়েছেন, তাঁর দলের মন্ত্রীরা ওই বিষয়ে মুখ না-খুললেও ভাল করবেন। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “মানুষ দেখেছেন, মনোজবাবু কী ভঙ্গিতে হাতের আস্তিন গুটিয়ে, টেবিল চাপড়ে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। যা বোঝার, তাঁরাই বুঝবেন। আমাদের কিছু বলার কী দরকার?” |