দেশের বাজেট নিয়ে মতামত জানাতে এসে রাজ্যের ঋণের বহর কমাতে ও উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় সাহায্যের দাবি করলেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
গত তিন বছর ধরেই বাজেটের আগে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের মতামত নিয়ে থাকেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। আজ সেই বৈঠকের শুরুতেই প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের জানিয়ে দেন, তিনি এখানে শুধু নীতিগত বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে চান। তাঁর মতে, রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য অন্য মঞ্চ রয়েছে। কিন্তু নীতিগত বিষয়ে মতামত জানানোর পাশাপাশি আজ অমিতবাবু ফের রাজ্যের ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্য কেন্দ্রের কাছে নগদ আর্থিক সাহায্যের দাবি করেছেন। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিশেষ আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। অতিরিক্ত ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল কেন্দ্র। আজ রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সড়ক-সংখ্যালঘু-নগরোন্নয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে একগুচ্ছ প্রকল্পে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার দাবি জানানো হয়েছে। অমিতবাবুর যুক্তি, “এই সব অর্থই নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যের মাথায় যে দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা বামফ্রন্ট সরকার চাপিয়ে গিয়েছে এবং যার জন্য বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা সুদ মেটাতে হয়, সেই ভার লাঘব করার জন্য নগদ অর্থ প্রয়োজন।” এই প্রসঙ্গে অমিতবাবুর দাবি, এ জন্য বাজেটেই পশ্চিমবঙ্গের জন্য ‘ইন্টারেস্ট অ্যান্ড রিপেমেন্ট কম্পেনসেটরি গ্রান্ট’ ঘোষণা করা হোক। তিন বছর এই খাতে রাজ্যকে নগদ অর্থ সাহায্য দেওয়া হলে রাজ্যের কোষাগারের পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে অমিতবাবু মনে করছেন। |
মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর সঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র । ছবি: পি টি আই |
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে আঘাত আসছে বলে তৃণমূল লোকপাল বিলের বিরোধিতা করেছিল। সেই রাজ্যের অধিকার খর্ব হওয়ার যুক্তিতে পণ্য-পরিষেবা কর নিয়েও যে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিবাদ করবে, আজ তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিত মিত্র। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের হাত থেকে কর বসানোর সমস্ত ক্ষেত্র কেড়ে নেওয়া হবে, অথচ কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজ্যেকে বেশি দায় নিতে হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য আর্থিক সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি অমিতবাবুর দাবি, যৌথ প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রকে অন্তত ৭৫ শতাংশ আর্থিক দায় নিতে হবে। অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, রাজ্যের কোষাগারের হাল ফেরাতে কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়াটা কোনও পাকাপাকি সমাধান নয়। রাজ্যকেও নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। রাজস্বের নতুন উৎস তৈরি করতে হবে। সে দিক থেকে রাজ্য পিছিয়ে রয়েছে বলেই কেন্দ্রের মত। এর জবাবে অমিতবাবু বলেছেন, “সিগারেট ও বিলিতি মদের উপর কর বাড়ানো হয়েছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, ই-গভর্ন্যান্স চালু করে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এতে সময় লাগবে, কিন্তু সুফল মিলবে।” |
কেন্দ্রীয় বাজেটে রাজ্যের দাবি |
স্বাস্থ্য
কলকাতায় রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ নিওনেটোলজি
রাজ্যের ১৬ লক্ষ গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি জোগাতে
৪৩২ কোটি পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ
|
বিক্রয় কর
ক্ষতিপূরণ হিসেবে গত বছরের ৬০০ কোটি, চলতি
অর্থবর্ষে ১১০০ কোটি ঋণের বোঝা কমাতে
বিশেষ নগদ সাহায্য |
সড়ক
জাতীয় সড়ক মেরামতিতে আরও অর্থ
স্টেট হাইওয়ে অথরিটির
জন্য ১০০ কোটি |
উচ্চ শিক্ষা
পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে বিশেষ সাহায্য প্রেসিডেন্সির
পরিকাঠামো, পঠন-পাঠন, গবেষণায় সাহায্য
দার্জিলিঙে একটি আইআইটি |
সংখ্যালঘু উন্নয়ন
মেয়েদের পাঁচটি পলিটেকনিক
ও ডিগ্রি কলেজ নির্মাণে সাহায্য
|
বিদ্যুৎ
বক্রেশ্বরে জাপানি সাহায্যে বিদ্যুৎ প্রকল্পে
ছাড়পত্র কয়লার দাম নিয়ন্ত্রণ |
সেচ
তিস্তা, সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, ময়ূরাক্ষী ও
ডিভিসি-তে পলি তুলতে সাহায্য |
বন্দর উন্নয়ন
সাগর থেকে রেল ও সড়ক
সেতু নির্মাণে সাহায্য |
জাতীয় গবেষণা কেন্দ্র
বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, নজরুল ইসলামের নামে গবেষণা কেন্দ্রের জন্য সাহায্য |
|
ইউপিএ-সরকারের একটা বড় অংশের মত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কাছে যে বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য দাবি করছেন, তার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে এই বিপুল পরিমাণ দাবি জানিয়ে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আরও বড় সংঘাতের রাস্তায় যেতে চাইছেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। অমিতবাবু আজ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি দিল্লি আসার আগে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর পরামর্শ নিয়ে এসেছেন। আর্থিক সংস্কারের নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে মনমোহন সরকারের সঙ্গে মমতার নীতিগত বিরোধ তৈরি হয়েছে। ইউপিএ সরকার মনে করছে, আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে মমতা বামপন্থীদের থেকেও কট্টর অবস্থান নিয়েছেন। আজ অনেকটা সেই সুরেই অমিতবাবু বলেন, “শুধু আর্থিক বৃদ্ধির পিছনে ছুটলে হবে না। তার সঙ্গে কর্মসংস্থানও তৈরি করতে হবে। নিও-ক্লাসিকাল ও কেইনসীয় তত্ত্বের বাইরে গিয়ে অর্থমন্ত্রীকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। যেমনটা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভাবছেন।” তাঁর যুক্তি, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে গিয়ে সুদের হার বাড়ানোর ফলেই আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে এসেছে। তাঁর উদ্বেগ, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমলে রাজ্যগুলিরও বৃদ্ধির হার কমবে। তাই বাজেটের মাধ্যমেই ফের ৯% হারে আর্থিক বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বণিকসভা তথা শিল্পমহল কিন্তু মমতার সরকারের নীতি নিয়ে সন্দিহান। তারা মনে করছে, কেন্দ্রে আর্থিক সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রাজ্যেও মমতার সরকার যে ধরনের নীতি নিচ্ছে, তাতে নতুন বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ বণিকসভা ফিকি-র প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, গত কয়েক বছরে শিল্প উৎপাদন বা নতুন বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলির থেকে পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু আজ অমিতবাবু দাবি জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারের টেবিলে ৬৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব রয়েছে। এই বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কেন্দ্রের কাছে বিদ্যুৎ-সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড়পত্র ও কয়লার দাম নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানিয়েছেন। |