পুরাকালে রাজা তো বটেই, মন্ত্রী-অমাত্যগণও পথিমধ্যে অবতরণ করিলে জনতা শশব্যস্তে পথ ছাড়িয়া দিত। সেই দিন গিয়াছে। রাজতন্ত্র প্রায় বিলুপ্ত। গণতন্ত্র আসিয়াছে। অভ্যাসটি যায় নাই। মন্ত্রিগণ পথে যাতায়াত করেন। শকটের শিরোপরে লাল বাতি জাগিয়া থাকে। জনতা পথ ছাড়িলে ভাল। কারণ, রাজ-দর্শনমাত্র পথ ছাড়িয়া দেওয়াই রীতি। যদি কেহ, এমনকী নির্ধারিত কর্তব্যবশতও পথরোধ করেন, তৎক্ষণাৎ লাল বাতি রাজপুরুষের রক্তচক্ষুর ন্যায় দেখা দেয়। মাত্রই কয়েক দিন পূর্বে গভীর রাতে রাজ্যের জনৈক মন্ত্রিবরের গাড়ির পথরোধ করা হইয়াছিল। নিশাকালে চলমান গাড়ি থামাইয়া পরীক্ষা পুলিশের নিত্যকর্মের মধ্যেই পড়ে। পূর্বে দেখা গিয়াছে, অপরাধীগণ এমন গাড়ি চাপিয়া পিঠটান দিবার বন্দোবস্ত করিয়া থাকে। সেই জন্যই এমন গাড়ি থামাইয়া পরীক্ষা করিবার আয়োজন। দুঃখের বিষয়, এই কর্তব্যবোধ দেখিয়া মন্ত্রিবর বিষম কুপিত হন। অভিযোগ, তিনি নাকি এই পথরোধের ভিতর সি পি আই এম-এর যোগসাজশ আবিষ্কার করেন এবং রোষকষায়িত লোচনে উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকদের কর্তব্যজ্ঞান সম্পর্কে কিঞ্চিৎ পরামর্শও প্রদান করেন। বিষয়টি নিশাকালের ভিতরেই মিলাইলে বলিবার কিছু থাকিত না। তাহা হয় নাই। বিষয়টি সর্বসমক্ষে আসিবার পরে বিতর্ক ঘনাইয়াছে। অতঃপর, দেখা গিয়াছে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী লালবাতি ব্যবহার না করিলেও তাঁহার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই লালবাতির প্রতি গভীর ভাবে অনুরক্ত। লক্ষণীয়, তাঁহারা অনেকেই ইহাকে ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে দেখেন না, বরং ইহা তাঁহাদিগের নিকট একটি উপায়মাত্র। নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াতের উপায়। প্রশ্ন হইল, আমজনতা যখন নিত্য ঝঞ্ঝাট, জ্যাম-জট ইত্যাদির ভিতর দিয়া যথাবিহিত কষ্ট স্বীকার করিয়াই যাইতেছে, তখন লালবাতি তুলনায় অনেক নির্ঝঞ্ঝাটে তথাকথিত বিশিষ্টজনদের যাতায়াত সম্ভব করে কী রূপে?
উত্তরটি পরিচিত। লালবাতি যে ক্ষমতার অভিজ্ঞান হইয়া গাড়ির উপরে বিদ্যমান থাকে, সেই ক্ষমতাই অন্য সব যানবাহনের গতিরোধ করিয়া লালবাতি-শোভিত গাড়িকে পথ ছাড়িয়া দেয়। সুতরাং, ক্ষমতা প্রদর্শন নহে, নিছকই সহজে যাইবার জন্য এই রক্তিম আলো, এই জাতীয় যুক্তির কোনও অর্থ নাই। সত্যকে সহজ ভাবে স্বীকার করাই বাঞ্ছনীয়। সেই সত্য ইহাও বলিবে যে, এই ধরনের ক্ষমতা প্রদর্শন সভ্যতার পরিচায়ক নহে। যে সভ্যতা গণতান্ত্রিক আবহে বিকাশ লাভ করে, তাহার সহিত ক্ষমতার এই বিশিষ্ট প্রকাশটি সঙ্গতিশীল নহে। মন্ত্রিগণ বিশিষ্ট এবং ব্যস্ত, সন্দেহ নাই, কিন্তু নির্দিষ্ট কর্মসূচি-ভিত্তিক গতায়াত কি লালবাতির ছাড়পত্র বিনা পালন করা একান্তই অসম্ভব?
যুক্তি বলিবে, ইহা আসলে মনোভঙ্গির সমস্যা। কাজ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক, কিন্তু কাজটি কী রূপে করা হইতেছে, সেই প্রক্রিয়াটিও ফেলিয়া দিবার নহে। কারণ, সেই প্রক্রিয়া হইতে নিহিত মনোভাবটি বাহির হইয়া আসে। সমস্যা হইল, সেই মনোভাবের ভিতরেই একটি সংকট থাকিয়া গিয়াছে। জনতার দিব্য গালিয়া করজোড়ে ভোট প্রার্থনা একটি রীতি। ক্ষমতায় আসীন হইবার পরে সেই জনতাকেই দূরে ঠেলিয়া লালবাতি-শোভিত গাড়িতে গতায়াত তেমনই একটি রীতি। শঙ্কা জাগে, প্রশ্ন উঠিলে সেই লালবাতিকে নিছকই একটি প্রক্রিয়াগত বিষয় বলিয়া কার্যত উপেক্ষা করাও হয়তো তেমনই একটি রীতি! দৃশ্যত, সুপ্রচলিত রীতি। ইহাতে একটি প্রশ্নের পাশ কাটানো চলে, বিষয়টির তাৎপর্য কমে না। নিশাকালে মন্ত্রিমহোদয়ের একটি ধাবমান গাড়ি একটি জরুরি প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে। প্রশ্নটির যথাযথ পশ্চাদ্ধাবন করা হইবে কি? |