বিশ্ববাসীর মধ্যে ক্ষুধার প্রকোপ কতখানি, তাহা জানিতে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ তৈয়ারি হইয়াছে। কোন দেশে কত মানুষ এখনও ক্ষুধা-আক্রান্ত, তাহা প্রকাশ করাই ইহার কাজ। এই সূচকে আফ্রিকার দক্ষিণের দেশগুলি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি বরাবরই সর্বাধিক ক্ষুধা-আক্রান্ত দেখাইয়াছে। ভারতের স্থান অতি লজ্জাজনক এখনও এ দেশে ২৩ কোটি মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট পায়। যে দেশ নিজেকে অতি-শক্তিশালী বলিয়া দাবি করে, যাহার অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলির একটি, সেই দেশে জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ পেট ভরিয়া খাইতে পারে না, এই সংবাদ নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনীতি এবং প্রশাসনিক নীতি লইয়া প্রশ্ন তোলে। আফ্রিকার দেশগুলিতে নিরন্তর সংঘর্ষ এবং এডস-এর মতো রোগের প্রবলতা ক্ষুধার প্রধান কারণ হইলেও, ভারতে ক্ষুধা এবং অপুষ্টির এই অতি-উচ্চ হারের কারণ প্রধানত মহিলাদের অপুষ্টি এবং অশিক্ষা, এমনই মনে করিতেছেন বিশেষজ্ঞরা। এই কারণটি বিশেষ চিন্তার যোগ্য।
বহু দিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ বহু মূল্য দিয়া ভারত ইহার সত্যতা উপলব্ধি করিতেছে। যাহাদের শিক্ষার অধিকারী করা হয় নাই, স্বাস্থ্যসুরক্ষা কিংবা পুষ্টিবিধান করা হয় নাই, সেই মহিলা, দলিত, জনজাতি এবং অন্যান্য অন্ত্যেবাসী মানুষেরা আজও নিজেদের ক্ষুধার অন্ন জুটাইতে পারিতেছে না। তাহাদের শিশুরাও ক্ষুধার্ত এবং অপুষ্ট রহিয়া যাইতেছে। কার্যত ইহাই তাহাদের এক ধরনের নিয়তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সম্পূর্ণ বস্তুটি এক ধরনের বিচিত্র এবং কুৎসিত চক্র। ক্ষুধা, অশিক্ষা এবং দারিদ্রের এই দুষ্টচক্রে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হইতেছে, অর্থনীতির বৃদ্ধি থমকাইয়া যাইতেছে, সামাজিক বিভাজন গভীরতর হইতেছে। অথচ, বিস্ময়কর কাণ্ডটি হইল, ভারতের ভূমিতেই যথেষ্ট খাবার উৎপন্ন হইতেছে, বিদেশ হইতেও খাদ্য আমদানি হইতেছে, বাজারে এবং সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থায় খাদ্যশস্যের অভাব নাই। তৎসত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট পাইতেছেন। ইহার অপেক্ষা লজ্জাজনক ব্যর্থতা জাতির কী হইতে পারে?
প্রসঙ্গত, নীতি প্রণয়ণ করিতে হইলে ক্ষুধা নিবারণের নীতি এবং অপুষ্টি প্রতিরোধের নীতি, দুইটিকে এক করিলে চলিবে না। অপুষ্টির কারণ নানাবিধ, ক্ষুধা অপুষ্টির একমাত্র কারণ নহে। ভারতে অপুষ্টি অতি ব্যাপক, মধ্যবিত্ত এবং ধনী পরিবারেও শিশুদের অপুষ্টি কিংবা মহিলাদের রক্তাল্পতা দেখা যায়। তাই অপুষ্টি দূর করিতে হইলে কেবল ক্ষুধানিবৃত্তির কথা ভাবিলেই হইবে না। শিশুর পরিবার কী ভাবে শিশুদের যথেষ্ট পরিমাণে যথাযথ খাবার খাওয়াইতে পারে, তাহার জন্য নানা উপায় চিন্তা করিতে হইবে। কিন্তু ক্ষুধা-জনিত অপুষ্টির হারও যে কম নহে, তাহা ক্ষুধা-সূচক সমীক্ষায় প্রতি বছর প্রকাশিত হইতেছে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু সংখ্যা অপেক্ষাও বড় তাৎপর্য মানবাধিকারের। খাদ্যে সকল মানুষেরই অধিকার রহিয়াছে, তাহা জীবনের অধিকারেরই অন্তর্গত। অপুষ্টি নিবারণের নীতিতে ভাবা যাইতে পারে, কী করিয়া সর্বাধিক ব্যক্তির অপুষ্টি কমিবে। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের নীতি স্থির করিতে হইবে এই উদ্দেশ্যে যে, একটি ব্যক্তিও যেন ক্ষুধার্ত না থাকে। সেই উদ্দেশ্য লইয়াই অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, মিড ডে মিল এবং রেশনব্যবস্থার মতো সরকারি উদ্যোগ শুরু হইয়াছিল। দুঃখের বিষয়, সেগুলি বহু ক্ষেত্রে কাজ করিতেছে না। আবার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিধানের দ্বারা দরিদ্রকে ক্ষুধা নিবৃত্তির সুযোগও দেওয়া হইতেছে না। এই অন্যায়ের নিরসন না করিলে ভারত বিশ্বের নিকট বারংবার অপদস্থ হইবে। |